- স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম একটি জাতির সার্বিক কল্যাণের সঙ্গে জড়িত। এই কল্যাণ সাধিত হয় আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সকল দিক থেকেই। বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম এবং কাঙ্ক্ষিত অর্জন প্রসঙ্গে দুটিকথা এমন এক সময় লিখতে বসেছি, যখন স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। বাঙালির স্বাধীনতা হঠাৎ করে অর্জিত হয়নি। এর পেছনে বহু শতাব্দীর অগণিত মানুষের সংগ্রাম, শোষণ-বঞ্চনাজাত ক্ষোভ, লড়াই ইত্যাদি একাকার হয়ে আছে। বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে এ অঞ্চলের মানুষের একটি নিজস্ব আইডেন্টিটি গড়ে ওঠে। তখন ধর্মীয় রাষ্ট্রিকভাবে বাঙালিরা অবজ্ঞা ও উপেক্ষার শিকার হয়েছে। ধর্মীয় পুরুতরা নানাভাবে তাঁদের হেয়প্রতিপন্ন করেছে। পুরনো গ্রন্থাদিতে বাঙালির যে পরিচয় পাওয়া যায় তাতে পক্ষীকুলের সঙ্গে তাদের তুলনা করা হয়েছে। সময়ের বিবর্তনে শাসকের পালাবদল হয়েছে। কোনো কোনো শাসক বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির পৃষ্ঠাপোষকতা করলেও এ জাতির জন্য স্বতন্ত্র ভূখণ্ড বা স্বাধীন দেশ ছিল কল্পনাতীত। পাল শাসকেরা বাংলা ভাষাকে মর্যাদাপূর্ণ স্থান দিয়ে এবং ভাষার চর্চা ও বিকাশের মাধ্যমে বাঙালির অগ্রগতির পথ অনেকটাই প্রশস্ত করে দেন। তবে এ ধারা বেশিদিন অব্যাহত থাকে না। সেন রাজাদের শাসনামলে ব্রাহ্মণ্য অনুশাসনে বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতি তথা বাঙালি জীবন আবার নিগ্রহের শিকার হয়। সকল দিক থেকেই নেমে আসে সংকট। এতে বাঙালির সাহিত্য-সংস্কৃতির পাশাপাশি স্বপ্নও পিষ্ট হয়। মুসলিম রাজত্বকালে কোনো কোনো শাসক বাংলা ভাষার পৃষ্ঠপোষকতা দান করলেও, এমনকি রাজদরবারে বাঙালির প্রবেশাধিকারের ব্যবস্থা করলেও তাদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়নি।
ব্রিটিশ শাসনামলে ঔপনিবেশি শাসকগোষ্ঠী এ অঞ্চলের মানুষকে নানাভাবে শাসন-শোষণ করেছে। এই শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালি সময় সময় বিদ্রোহ করেছে। এতে তাঁদের মধ্যে দেশাত্মবোধ ও স্বাধীনতার স্পৃহা জাগ্রত হয়েছে। স্বাধীনতা হীনতায় যে কেউ বাঁচতে চায়না, এ বোধও কারো কারো মনে উদয় হয়েছে। বেনিয়াদের শোষণের মাত্রা বৃদ্ধির পাশাপাশি বাঙালির প্রতিবাদের ধরনও বদলেছে। লেখা কিংবা রাজপথের প্রতিবাদ নয়, জীবনপণ প্রতিজ্ঞা করে বাঙালি সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছে। গুপ্ত হামলা কিংবা সশস্ত্র আক্রমণ করেছে এই প্রত্যয়ে যে, দেশের জন্য হয় মারবো, নয় মরবো। এ কাজে অবতীর্ণ হয়ে অনেকে মৃত্যুঞ্জয়ী পর্যন্ত হয়েছে। তিতুমীর, ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, প্রীতিলতা আরও অনেক বিপ্লবী জাতিকে পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত করতে আত্মাহুতি দিয়েছেন।
ইংরেজ শাসকেরা বাঙালিকে চিরকালের জন্যে শাসন-শোষণ করতে চাইলেও তাদের আমদানি করা বিদ্যা-বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে বাঙালি গণতান্ত্রিক মূল্যাবোধ, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধ, এমনকি জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত হয়েছে। অনেক রাজনৈতিক দল যেমন গড়ে উঠেছে, তেমনি আবির্ভাব ঘটেছে অনেক জাতীয়তাবাদী নেতার। কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, কমিউনিস্ট পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিয়মতান্ত্রিকভাবে স্বাধীনতার আন্দোলন গড়ে তুলেছে; সময় সময় ডাক দিয়েছে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের। সন্ত্রাসবাদী অনেক সংগঠন নেমেছে সশস্ত্র সংগ্রামে। পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও তাতে শামিল হয়েছে। এসব রাজনৈতিক দলের সংঘবদ্ধ প্রয়াসে এবং দেশবাসীর প্রবল চাপে এক সময় ইংরেজ দেশ ছেড়েছে। দীর্ঘ শাসন-শোষণের পর ইংরেজ দেশ ছাড়লে বাঙালি স্বাধীন দেশের নাগরিক হলেও স্বতন্ত্র্র আবাসভূমি পায়নি। পায়নি স্বাধীনতা কিংবা মুক্তির স্বাদও। শাসক বদলেছে, বদলেছে দেশে মানচিত্র; কিন্তু বদল হয়নি শোষণ। শুধু কি তাই? বদল তো হয়ই-নি; বরং তাতে যুক্ত হয়েছে নতুন মাত্রা। এর ফলে বাঙালিকে নতুন প্রত্যয়ে অগ্রসর হতে হয়েছে। শপথ নিতে হয়েছে ইস্পাতকঠিন ঐক্যের।
ইংরেজ গেলো, পাকিস্তান এলো, কিন্তু বাঙালি কি পেলো? যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য তারা সংগ্রাম করেছে, স্বপ্ন দেখেছে। সেই পাকিস্তানে নব্য ঔপনিবেশিক শাসন কায়েম হলো। নতুন মাত্রায় শুরু হলো শাসন-শোষণ এবং বঞ্চনা। ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক সকল দিক থেকেই শুরু হলো শোষণ। বারো-শ মাইল দূরে রাজধানী স্থাপিত হলো, যার সঙ্গে বাঙালির সংযোগ স্থাপন করতে হলে মাঝখানে একটি রাষ্ট্র ডিঙিয়ে যেতে হতো। প্রতিনিয়িত ঘটতে থাকলো আশাভঙ্গের ঘটনা। দেয়ালে পিঠ ঠেকতে ঠেকতে অতঃপর শুরু হলো ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয়। ভাষা-আন্দোলন সর্বপ্রথম বাঙালির চোখ খুলে দিলো। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর, আউয়াল, অহিউল্লাহর রক্তের শপথে পূর্ববঙ্গের সকল মানুষ জেগে উঠলো। পাকিস্তানি ধর্মীয় ভাবাদর্শের বিপরীতে জাগ্রত হলো ভাষা-সংস্কৃতিভিত্তিক এক নবচেতনা। এই চেতনা অসাম্প্রদায়িক ভাবধারায় পুষ্ট হয়ে বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করে ফেললো। এর প্রথম প্রকাশ লক্ষ করা গেল ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে। এ নির্বাচনে একুশের চেতনায় দীপ্ত হয়ে পূর্ববঙ্গের মানুষ ধর্মীয় উন্মাদনায় সৃষ্ট মুসলিম লীগের কবর রচনা করলো। শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের নেতৃত্বে বাঙালির সরকার গঠিত হলো। কিন্তু বেশিদিন তা স্থায়ী হলো না। কেন্দ্রের শাসন জারি করে বাঙালিদের অধিকার আবারও স্তব্ধ করা হলো। ক্ষমতার ঘন ঘন পালাবদলের এক পর্যায়ে ১৯৫৮ সালে জারি করা হলো সামরিক শাসন। ক্ষমতা দখল করলেন আইয়ুব খান। এরপর পুরো জাতির স্বপ্ন পিষে দেওয়া হলো সামরিক শাসকের বুটের তলায়। কিন্তু যে জাতির রক্তে আগুন, তাদের কি থামিয়ে রাখা যায়? সামরিক শাসনের শৃঙ্খল ভাঙতে ছাত্ররা রাজপথে নেমে এলো। বাষট্টির ছাত্র আন্দোলনের পথ ধরে এলো ৬-দফা আন্দোলন।
শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক তখন বয়সের ভারে রাজনীতির পাদপ্রদীপের আলো থেকে ক্রমে দূরে সরে গেছেন। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ক্রমাগত সিদ্ধান্ত বদলের কারণে ঐক্যবদ্ধ জাতির কাণ্ডারি হিসেবে আশার আলো জ্বালাতে পারছিলেন না। বামপন্থীরা নানা দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে জনআকাঙ্ক্ষা পূরণের উপযোগী করে নিজেদের হাজির করতে পারছিলেন না। এমতবস্থায় নবজীবনের আহবানে একটি কণ্ঠ ক্রমে প্রবল হতে থাকে। ভাষা-আন্দোলন থেকে স্বাধিকার-গ্রামের যাত্রাপথে তিনি ক্রমে রাজনীতির পাদপ্রদীপের আলোয় চলে আসেন। এ অঞ্চলের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সর্বৈব বৈষম্য দূর করতে ৬-দফা কর্মসূচি নিয়ে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে সফর করে পুরো জাতিকে জাগিয়ে তোলেন। তাঁর এই আহবানে জনগণের সাড়া দেওয়া দেখে সামরিক শাসক আইয়ুব খানের টনক নড়ে। দায়ের করা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। বাঙালিকে দমন করতে চালানো হয় অত্যাচারের স্টিমরোলার। মামলা-হামলা জেল-জুলুমের মাধ্যমে তাঁদের স্তব্ধ করার অপচেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু দমন যতই বাড়ে, বাঙালির প্রতিরোধ ও ঐক্য ততই প্রবল হয়। ছাত্র-জনতার দুর্বার আন্দোলনে গণ–অভ্যুত্থান ঘটে যায়। বাঙালির ঐক্যের প্রতীক, মুক্তিসংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে তথাকথিত লৌহমানব আইয়ুব খান মুক্তি দিতে বাধ্য হন। ছাত্র-জনতা তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। মুক্ত হয়েই শেখ মুজিব জাতিকে মুক্তি মোহনায় পৌঁছে দিকে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন। ক্ষমতার মসনদ থেকে বিদায় ঘটে আইয়ুব খানের। এদিকে সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ লাভ করে ভূমিধস বিজয়। কিন্তু তাতেও বাঙালিকে স্তব্ধ করার দুঃস্বপ্ন যায় না পাকিস্তানিদের মন থেকে। বঙ্গবন্ধু ডাক দেন অসহযোগ আন্দোলনের। শুধু তাই নয়, রেসকোর্স ময়দানে অগণন মানুষের সামনে তিনি সংগ্রামী জনতাকে উদাত্ত কণ্ঠে আহবান জানান, যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রু মোকাবেলার। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহবানে জানিয়ে আরও বলেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। এও বলেন, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো, এদেশের মানুষকে তবু মুক্ত করেই ছাড়বো ইনশআল্লাহ।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের পর পাকিস্তানি সামরিক জান্তা আরও মরিয়া হয়ে ওঠে। এবার অস্ত্রের ভাষায় বাঙালিকে স্তব্ধ করে দিতে মাঠে নামায় প্রশিক্ষিক সৈন্যবাহিনী। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে ‘অপারেশন সার্চলাইটে’র নামে পাকিস্তানি সৈন্যরা শুরু করে গণহত্যা। গ্রেফতার করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। গ্রেফতারের প্রাক্কালে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং শত্রু শেষ চিহ্ন থাকা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার আহবান জানান। তাঁর এই ঘোষণা একাধিক ব্যক্তির কণ্ঠের মাধ্যমে পৌঁছে যায় সর্বত্র। শুরু হয় মরণজয়ী যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধ পরিচালনার জন্য তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে গঠন করা হয় মুজিবনগর সরকার। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে শিরোধার্য করে তাজউদ্দীন আহমদ অতি দৃঢ়তার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো বন্ধুরাষ্ট্র সহযোগিতার হাত বাড়ায়। বাংলার সর্বস্তরের মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে কঠিন আগ্মত্যাগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করে স্বাধীন বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করলে অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়।
দীর্ঘ সংগ্রামের পর স্বাধীনতা লাভ করলেও বাঙালির সার্বিক মুক্তি এখনো আসেনি। যদিও বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণে আগে মুক্তি তারপর স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন। স্বাধীনতা অর্জনের ফলে আমরা একটি স্বাধীন-সার্বভৌম ভূখণ্ড পেয়েছি, পেয়েছি লাল-সবুজ পতাকা এবং সরকার ব্যবস্থা। এটা নিঃসন্দেহে বাঙালির জন্যে গৌরবের ব্যাপার। পৃথিবীর বহু জাতি যুগের পর যুগ সংগ্রাম করেছে কিন্তু স্বাধীন দেশ লাভ করতে পারেনি। জাতির মুক্তির প্রশ্নে প্রথম যে বিষয়টি সামনে আসে সেটি হলো অর্থনৈতিক উন্নয়ন। পাকিস্তানিরা যে কারণে বাঙালিদের দুশমনে পরিণত হয়েছিলো, তার মূলে ছিলো অর্থনৈতিক শোষণ। অর্থাৎ অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি করে পাকিস্তানিরা এ অঞ্চলের মানুষকে শোষণ করেছে, বঞ্চিত রেখেছে। এ কারণেই বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক মুক্তির ডাক দিয়ে তাঁদের সংগঠিত করেছিলেন। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরে বর্তমানে আমাদের মাথাপিছু আয় বাড়লেও এবং জীবনমান অনেকক্ষেত্রে উন্নত হলেও সার্বিক অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটেনি। বর্তমানে ধনী-দরিদ্রের সম্পদে সীমাহীন ফারাক যেমন সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি বহু মানুষ বাস করছে দারিদ্র্য সীমার নিচে। এছাড়া সকল মানুষের সমান অধিকারের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশও নির্মিত হয়নি। সাম্প্রদায়িক শক্তির হিংস্র থাবায় বারবার রক্তাক্ত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র। সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হলো জাতির পিতাকে পর্যন্ত এদেশের মাটিতে স্বপরিবাশে হত্যা করা হয়েছে। শুধু কি তাই? জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে হত্যা করা হয়েছে জাতীয় চার নেতাকেও। একাত্তরের পরাজিত শক্তি ও দালের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা মীরজাফরের উত্তরসূরিরা বঙ্গবন্ধু তাঁর সহচরদের হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, সে হত্যা বিচারের পথও দীর্ঘকাল রুদ্ধ করে রেখেছিল। এর ফলে স্বাধীন দেশে আইনের শাসন গুমড়ে গুমড়ে কেঁদেছে যুগের পর যুগ। সামরিক স্বৈরাশাসকেরা নিজেদের ইচ্ছামতো সংবিধানকে বদল করেছে। গণতন্ত্রের স্বাভাবিক বিকাশের পথ রুদ্ধ করেছে। নির্বাচিত সরকারগুলোও প্রতিপক্ষকে দমনে সময় সময় রাষ্ট্রীয় শক্তির অপপ্রয়োগ করেছে। জঙ্গিবাদী অপশক্তির আস্ফালনও দেখতে হয়েছে এ জাতিকে। এসব কারণে স্বাধীনতার সংগ্রামে জিতলেও বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম এখনো চলমান।
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও দেশের উন্নতি ঘটেছে। মানুষের জীবন-মান উন্নত হয়েছে। শিক্ষার হার বেড়েছে, বেড়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও। অবকাঠানো নির্মাণের পাশাপাশি জাতীয়করণ করা হয়েছে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। জাতিকে উন্নত ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে গড়ে তোলা হয়েছে নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয। চিকিৎসা, যোগাযোগ খাতসহ সকল ক্ষেত্রেই উন্নতি সাধিত হয়েছে। নিজম্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতুর মতো বিপুল ব্যয়ের প্রকল্প বাস্তবায়ন বাংলাদেশের আর্থিক সক্ষমতারই প্রমাণ। এছাড়া মহাকাশে স্যাটেলাইট প্রেরণ, মেট্রোরেল নির্মাণ, ট্যানেল নির্মাণ, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের মতো ঘটনা নিঃসন্দেহে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের বড় অর্জন। তথ্য-প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন ছাড়াও সামাজিক নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। বছরের শুরুতে শিশুদের বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক প্রদান, শিক্ষাবৃত্তি প্রদান, বয়স্কভাতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বৃদ্ধি সামাজিক উন্নয়নে অবদান রেখেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, একাত্তরের মানবতাবিরোধীদের বিচার এবং বিচারের রায় কার্যকর আইনের শাসনের পথে কয়েক ধাপ অগ্রগতির প্রমাণ বহন করছে। এক কথায় স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে আমাদের প্রাপ্তি নিতান্ত কম নয়। এসবের মূলে রয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘকালের সংগ্রাম, সুদূরপ্রসারী কর্মপরিকল্পনা এবং স্বপ্ন; যার সিংহভাগই বাস্তবায়ন করেছেন তাঁর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশের এই যে অগ্রগতি, এর মূলে প্রধানভাবে অবদান রেখেছেন এদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী; কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ। কৃষকদের উৎপাদিত ফসলে আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। পোশাক শিল্পের শ্রমিক এবং প্রবাসী শ্রমিকদের শ্রম ও ঘামে যে রেমিটেন্স এসেছে, তাতে আমাদের অর্থনীতির ভিত মজবুত হয়েছে। এখন সময় এসেছে দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনের। সবার আগে দেশকে গুরুত্ব দিতে হবে। স্ব-স্ব দায়িত্ব দক্ষতা, নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে পালন করতে হবে। দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে হবে। দুর্নীতিবাজদের কঠোরভাবে দমন করতে হবে। অসাম্প্রদায়িকতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সকল মানুষের সমান অধিকার এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখতে হবে। সে স্বপ্ন বুকে নিয়ে বাংলার দামাল সন্তানেরা হাসতে হাসতে জীবন বিসর্জন দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছেন, তাঁদের স্বপ্নের সেই কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ বিনির্মাণে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জাতিকে এগিয়ে নিতে হলে যুগোপযোগী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। সর্বোপরি স্বাধীনতার সুফল জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হবে। নতুন প্রজন্মকে উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সকল সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। একটি উন্নত ও আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার কাজে সকলকে আত্মনিয়োগ করতে হবে। আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি, এই দেশের প্রতিটি নাগরিকের সার্বিক মুক্তিই হবে এখন আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। বিজয় দিবসের এই মাহেন্দ্রক্ষণে এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: ড. এম আবদুল আলীম