সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অধিকতর উন্নয়নে বাংলাদেশের করণীয়
বাংলাদেশ, তার সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের জন্য, বরাবরই বিভিন্ন ধর্মীয়, জাতিগত এবং ভাষাগত গোষ্ঠীর এক অনন্য মিলন মেলা। যদিও দেশের বেশিরভাগ মানুষ ইসলাম ধর্ম পালন করে, তবু এখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হিন্দু, খ্রিষ্টান এবং বৌদ্ধ সম্প্রদায়ও বাস করে। মাঝে মাঝে বিচ্ছিন্ন কিছু উত্তেজনা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটি প্রশংসনীয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখেছে, যা শান্তি রক্ষা এবং দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ঐতিহাসিকভাবে বৃহত্তর বঙ্গীয় অঞ্চলের অংশ হিসেবে, বাংলাদেশ বিভিন্ন ধর্ম এবং সংস্কৃতির একটি মিলনস্থল। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, খ্রিষ্টান ধর্ম এবং ইসলাম ধর্ম একসঙ্গে সহাবস্থান করেছে, একে অপরকে প্রভাবিত করে একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গঠনে অবদান রেখেছে। এই ধর্মীয় ঐতিহ্যের সংমিশ্রণ বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংগীত এবং উৎসবগুলোতে প্রতিফলিত হয়েছে।
ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ঔপনিবেশিক আমলে, বিভাজনমূলক নীতির কারণে মাঝে মাঝে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ এবং ১৯৪৭ সালে ভারতের বিভাজন, যার ফলে পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) সৃষ্টি হয়, তা উল্লেখযোগ্য সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সাক্ষী হয়। তবু পূর্ববঙ্গ (পরে বাংলাদেশ)-এর জনগণ মূলত সহাবস্থানের চেতনাকে ধরে রেখেছিল, সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগত পরিচয়কে ধর্মীয় পার্থক্যের ওপর অগ্রাধিকার দিয়েছিল।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম ১৯৭১ সালে স্ব-নিয়ন্ত্রণ, ভাষাগত অধিকার এবং সাংস্কৃতিক স্বীকৃতির আকাঙ্ক্ষা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ধর্মীয় বিভাজনকে অতিক্রম করে সমতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির ভিত্তিতে লড়াই করা হয়েছিল। যার পরিপ্রেক্ষিতে বহু ত্যাগের বিনিময়ে গঠিত নতুন জাতি একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়, যার সংবিধান সব নাগরিকের জন্য ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সমান অধিকার নিশ্চিত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ।
স্বাধীনতার পরের বছরগুলোতে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি প্রতিশ্রুতি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ইসলামপন্থি গোষ্ঠীগুলোর উত্থান দেশের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোর জন্য হুমকি সৃষ্টি করেছিল। তবু পরবর্তী সরকার এবং নাগরিক সমাজ সাধারণত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নীতি বজায় রেখেছে এবং সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বা বৈষম্যের ক্ষেত্রে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অবস্থা সাংস্কৃতিক সংহতির মাধ্যমে চিহ্নিত করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, দুর্গাপূজা, ঈদ, বড়দিন এবং বুদ্ধ পূর্ণিমার মতো উৎসব উদযাপনে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে, যা পারস্পরিক শ্রদ্ধার প্রতিফলন। সরকার ধর্মনিরপেক্ষতা প্রচার এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় পদক্ষেপ নিয়েছে, যেমন- ধর্মীয় উৎসবগুলোর সময় নিরাপত্তা প্রদান এবং ধর্মীয় স্থানগুলোর সংরক্ষণ। এছাড়াও বিভিন্ন এনজিও এবং নাগরিক সমাজ আন্তধর্মীয় সংলাপ প্রচার এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় সবসময় সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
তবে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে এমন বিভিন্ন বিষয়ে সজাগ থাকা প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়ই ধর্মকে ব্যবহার করে জনসমর্থন অর্জন করার চেষ্টা করে, যা সাম্প্রদায়িক অনুভূতিকে উসকে দিতে পারে। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিরতা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাকে বাড়িয়ে তুলতে পারে।
অর্থনৈতিক বৈষম্য অনেক সময় ক্ষোভের জন্ম দিতে পারে এবং সংঘাতের দিকে নিয়ে যেতে পারে। তাছাড়া গণমাধ্যমের বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ার ভূমিকা দ্বিমুখী। এটি একদিকে যেমন ঐক্যকে সুসংহত করতে পারে, তেমনি এটি দ্রুত ভুল তথ্য ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়াও আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব, বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর ধর্মীয় চরমপন্থার প্রভাব, বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি উন্নয়নে কৌশল তৈরি করার সময় আঞ্চলিক প্রেক্ষাপট অনুধাবন করা গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, ভারতের ধর্মীয় বৈচিত্র্য রয়েছে, যেখানে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান, শিখসহ অন্যান্য ধর্মের অনুসারীরা বসবাস করে। তথাপি সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সেখানে একটি স্থায়ী সমস্যা, যা প্রায়ই হিন্দু এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐতিহাসিক উত্তেজনার সঙ্গে সম্পর্কিত। উদাহরণস্বরূপ, গুজরাট দাঙ্গা (২০০২) চলাকালীন ১ হাজারের বেশি মানুষ, প্রধানত মুসলমান নিহত হয়েছিল।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সাম্প্রদায়িক ঘটনার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, যার সঙ্গে হিন্দু জাতীয়তাবাদী মনোভাব এবং সম্পর্কিত সংঘাতের উত্থান হয়েছে।
শ্রীলঙ্কার সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঐতিহাসিকভাবে সিংহলী সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং তামিল সংখ্যালঘুদের মধ্যে জাতিগত উত্তেজনার সঙ্গে সম্পর্কিত, ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর সঙ্গে নয়। তবে, মুসলিম এবং খ্রিষ্টানদের লক্ষ্য করে ধর্মীয় সহিংসতাও ঘটেছে। ২০১৮ সালে কান্ডির মুসলিমবিরোধী দাঙ্গায় দুই জন মুসলমান নিহত এবং ব্যাপক সম্পত্তি ক্ষতি হয়েছিল। অধিকন্তু, বিশেষ করে মুসলিম সম্প্রদায় ২০১৯ সালের পর থেকে বাড়তি সহিংসতার শিকার হচ্ছে।
এ অঞ্চলের অবস্থা বিশ্লেষণ থেকে প্রতীয়মান হয় যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কিছু প্রতিবেশী দেশের তুলনায় তুলনামূলক ভালো অবস্থানে রয়েছে।
এবার দেখা যাক প্রচলিত ধর্মগুলো এ বিষয়ে কি অনুশাসন প্রদান করেছে। পৃথিবীতে প্রচলিত সব ধর্ম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। পবিত্র কোরআনে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সম্পর্কিত সবচেয়ে প্রভাবশালী আয়াতগুলোর মধ্যে একটি সুরা আল-হুজুরাতে (৪৯:১৩ ) পাওয়া যায়। যেখানে এরশাদ করা হয়, ‘হে মানব জাতি, অবশ্যই আমরা তোমাদের পুরুষ ও নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের জাতি ও গোত্রে পরিণত করেছি, যাতে তোমরা একে অপরকে চিনতে পার। আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সম্মানিত সেই ব্যক্তিই, যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধার্মিক, নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও অবহিত।’ এই আয়াতটি বিভাজনের পরিবর্তে পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং সহাবস্থানকে উৎসাহিত করে। ধর্মীয় স্বাধীনতা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির একটি মূল দিক বলেও কোরআনে জোর দেওয়া হয়েছে। সুরা আল-বাকারাহ (২:২৫৬ )-তে বলা হয়েছে ‘ধর্ম গ্রহণের ক্ষেত্রে কোন জবরদস্তি থাকবে না। সঠিক পথ ভুল থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে।’ এ আয়াতটির মাধ্যমে তুলে ধরা হয় যে বিশ্বাস একটি ব্যক্তিগত বিষয় এবং অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়।
এছাড়া নবী মুহাম্মাদ (সা.) বিভিন্ন ধর্মের ব্যক্তিদের প্রতি দয়া ও সম্মান প্রদর্শনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। মদিনার সনদ এই প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক উদাহরণ। এক হাদিসে নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন: ‘যে ব্যক্তি কোনও মুয়াহিদকে হত্যা করে (একজন অমুসলিম যার সঙ্গে মুসলমানদের চুক্তি আছে) সে জান্নাতের ঘ্রাণ পাবে না, যদিও তার সুগন্ধি চল্লিশ বছরের দূরত্বে পাওয়া যায়।’ (সহি বুখারি)। হাদিসটি অমুসলিমদের সুরক্ষা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার গুরুত্বের ওপর জোর দেয়।
পাশাপাশি ভগবত গীতায় (হিন্দু ধর্মগ্রন্থ) সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সামাজিক শৃঙ্খলা ও শান্তি বজায় রাখার ক্ষেত্রে প্রত্যেক ব্যক্তির একটি স্বতন্ত্র ভূমিকা এবং বাধ্যবাধকতা রয়েছে মর্মে উল্লেখ রয়েছে। অধ্যায় ৩, শ্লোক ৩৫-এ বলা হয়েছে: ‘অসম্পূর্ণভাবে অন্যের ধর্ম পূরণ করার চেয়ে নিজের ধর্মকে অসম্পূর্ণভাবে পূর্ণ করা ভালো। নিজের সহজাত প্রকৃতি অনুসারে কাজ করলে, একজনের পাপ হয় না।’
এই অনুচ্ছেদটি ব্যক্তিদের অন্যের দায়িত্বে হস্তক্ষেপ করার পরিবর্তে তাদের নিজস্ব দায়িত্বে মনোনিবেশ করার আহ্বান জানায়, প্রতিটি ব্যক্তির পথকে সম্মান করে সম্প্রীতি প্রচার করে। এছাড়া অধ্যায় ৫, শ্লোক ১৮, গীতায় সমতার বার্তা দেওয়া হয়েছে: ‘জ্ঞানীরা জ্ঞানী ব্রাহ্মণ, গরু, হাতি, কুকুর এবং কুকুর ভক্ষকের মধ্যে কোন পার্থক্য দেখেন না।’ এই শ্লোকটি এই বিশ্বাসের ওপর জোর দেয় যে সব প্রাণী ঐশ্বরিক দৃষ্টিতে সমান, যা মানুষকে কুসংস্কার এবং পক্ষপাতগুলো অতিক্রম করতে উৎসাহিত করে, একইভাবে ঐক্য ও সম্প্রীতিকে লালন করে।
উপরন্তু, বাইবেল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ভিত্তিপ্রস্তর হিসাবে প্রেম এবং সমবেদনাকে জোর দেয়। ম্যাথিউরের গসপেল (২২:৩৯), যিশু বলেছেন: ‘তুমি তোমার প্রতিবেশীকে নিজের মতো ভালোবাসবে।’ এই আদেশটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিষয়ে খ্রিষ্টান শিক্ষার সারমর্মকে প্রকাশ করে।
দেশের প্রেক্ষাপট এবং বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ কিছু কৌশলকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বিবেচনা করতে পারে, যা চলমান এবং টেকসই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
১। আন্তঃধর্মীয় সংলাপ পরিচালনা করা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বৃদ্ধির অন্যতম কার্যকর উপায়। বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা উৎসাহিত করা ভুল বোঝাবুঝি দূর করতে এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারে।
ধর্মীয় নেতা ও সম্প্রদায়ের প্রভাবশালীরা এই সংলাপগুলো কার্যকর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে নিয়মিত আন্তঃধর্মীয় ফোরাম, কর্মশালা এবং সেমিনার আয়োজন করা যেতে পারে যা ঐক্যের অনুভূতি তৈরি করতে সহায়তা করবে।
২। শিক্ষা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। বাংলাদেশের স্কুলগুলোতে পাঠ্যক্রমে ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সম্পর্কে আরও নতুন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত, যাতে সমস্ত সম্প্রদায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের গুরুত্ব বোঝানো যায়। সেইসাথে, পাঠ্যবইগুলোতে যে কোনও ঘৃণা বা বৈষম্যকে উস্কে দিতে পারে এমন বিষযয়বস্তু থাকলে তা বাদ দিয়ে এর পরিবর্তে দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অবদানকে তুলে ধরা উচিত। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশে থাকা বিভিন্ন বৈচিত্র্যকে মূল্যায়ন করতে সাহায্য করার জন্য সাংস্কৃতিক বিনিময় কর্মসূচি এবং বিভিন্ন ধর্মীয় স্থানে ভ্রমণের মতো কার্যক্রমগুলোতে জড়িত করা যেতে পারে।
৩। গণমাধ্যমের জনমত গঠনে উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে এবং এটি বিভাজন বা ঐক্য উভয় ক্ষেত্রেই অবদান রাখতে পারে। বাংলাদেশে, গণমাধ্যমগুলোকে সংবেদনশীলতা এড়িয়ে আরও দায়িত্বশীল প্রতিবেদন প্রচার করার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সেই সাথে যা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার ঘটনা আরও খারাপ করতে পারে তার পরিবর্তে, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, আন্তঃধর্মীয় সহযোগিতা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদাহরণগুলোকে তুলে ধরার উপর মনোযোগী হতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি নজড়দারি ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
৪। শিক্ষা এবং সংলাপ গুরুত্বপূর্ণ হলেও, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা মোকাবিলা এবং প্রতিরোধে শক্তিশালী আইনি কাঠামোও প্রয়োজন। বাংলাদেশে ঘৃণা ভাষণ, বৈষম্য এবং সহিংসতায় উস্কানি দেওয়ার বিরুদ্ধে আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করা প্রয়োজন। সেই সাথে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকারদের জন্য দ্রুত এবং নিরপেক্ষ বিচার ভবিষ্যতের ঘটনার বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধক হিসাবে কাজ করতে পারে।
৫। মাঠ পর্যায়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি উন্নয়নে উদ্যোগ গ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। স্থানীয় সম্প্রদায়গুলোকে বিভিন্ন ধর্মীয় এবং জাতিগত পটভূমির সদস্যদের নিয়ে গঠিত শান্তি কমিটি স্থাপনে উদ্বুদ্ধ করা উচিত। এই কমিটিগুলি সংঘাত নিরসন, যৌথ সম্প্রদায়িক কার্যক্রম আয়োজন, এবং সম্ভাব্য উত্তেজনার উৎস মোকাবিলায় স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করতে পারে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বন্ধুত্ব এবং পারস্পরিক সম্মান বাড়ানোর জন্য ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক উৎসব একসাথে উদযাপন করাও সহায়ক হতে পারে।
৬। পাশাপাশি, অর্থনৈতিক বৈষম্য যাতে সৃষ্টি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা গুরুত্বপূর্ণ। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য সরকারি এবং বেসরকারি খাতের মধ্যে সহযোগিতা অপরিহার্য। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, পেশাগত প্রশিক্ষণ উদ্যোগের মতো কর্মসূচি অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস এবং সামাজিক সংহতি উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে।
৭। অধিকন্তু, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি উন্নয়নে সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক নেতাদের সকল সম্প্রদায়ের অধিকার সুরক্ষায় এবং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় পরিচয় গঠনে দৃঢ় প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করতে হবে। বৈচিত্র্য এবং অন্তর্ভুক্তিকে সমর্থন করে এমন নীতিগুলিকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং বিভেদ সৃষ্টিকারী বক্তব্য দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করা জরুরি।
এছাড়াও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে সকল ধর্মের প্রতিনিধির যথাযথ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য সরকারের কাজ করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি তার জনগণের দৃঢ়তা এবং শক্তির একটি সাক্ষ্য। চলমান চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি অঙ্গীকার এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা সময়ের দাবি। বাংলাদেশ যতই অগ্রসর এবং রূপান্তরিত হোক না কেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সমুন্নত রাখার প্রতিশ্রুতিকে ধরে রাখা জরুরি যাতে দেশটি এই অঞ্চলে শান্তি এবং সহাবস্থানের একটি আদর্শ প্রতীক হিসাবে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করে। শিক্ষা, গণমাধ্যম এবং আন্তঃধর্মীয় সংলাপে টেকসই প্রচেষ্টার মাধ্যমে, বাংলাদেশ তার সমৃদ্ধ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করে একটি অধিকতর অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যতের পথ প্রশস্ত করতে পারে।
লেখক: ড. মোহাম্মদ কামরুল হাসান লোকপ্রশাসন বিষয়ক গবেষক।
mkhmiraz@gmail.com