বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে ছিলেন, তাঁর জন্ম-পরিচয় ও অবদান নতুন করে লেখার কিছু নেই। গত পনের বছরে বহুবার তা চর্চিত হয়েছে। স্বাধীনতার সংগ্রাম থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে তার নাম বারবার উচ্চারিত হবে। তার নাম বাদ দিয়ে বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস লেখা সম্ভব নয়।
কিন্তু সদ্য নির্বাসিত সরকারের সময়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সঠিকভাবে ইতিহাস চর্চা করা হয়নি। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত বই পুস্তকে ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা লাভের আশায় তেলবাজিতে ব্যস্ত লেখকদের লেখা-বক্তৃতায় তাকে নির্মোহভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। অধিকাংশ লেখায় কেবল তাঁর গুনকীর্তন চোখে পড়ে। যদিও লেখক-চিন্তক-বুদ্ধিজীবীদের বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর অবদান ও স্বাধীনাত্তোরকালে শাসক হিসেবে তাঁর সামগ্রিক কার্যক্রমকে ক্রিটিক্যাল থিকিংয়ের মাধ্যমে বিচার-বিশ্লেষণ করার কথা ছিল। তবে ২০০৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত প্রকাশনাগুলোয় ওই ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ের অনুপস্থিতি প্রবলভাবে চোখে পড়ে।
এক্ষেত্রেও তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন অথবা ওই সময়ে ভয়ের সংস্কৃতি চালু ছিল বলেই লেখক-চিন্তক-বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে নির্মোহ ইতিহাস রচনা করা সম্ভব হয়নি বিষয়টি এমন নাকি এদেশের বুদ্ধিজীবী-লেখক-চিন্তকদের মেরুদণ্ডের অভাব আছে তাই তারা লিখতে পারেননি সেই বিষয়টি প্রশ্নসাপেক্ষ।
বাংলাদেশের জনপরিসরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধিকার আন্দোলনের ভূমিকা স্বাধীনতার স্বপক্ষের প্রায় সব মহলে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। তবে স্বাধীনতাত্তোরকালে তার শাসনামল নিয়ে বাংলাদেশের জনপরিসর বহুধাভাবে বিভক্ত। ওই বিভক্তি দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে ইতিহাসের আয়নায় তার বিচার করা ঐতিহাসিকদের দায়ের মধ্যে পড়ে। কিন্তু বিগত সময়ের কোনও লেখায় তার শাসনকাল নিয়ে কোনও সমালোচনামূলক লেখা চোখে পড়েনি। সব যেন স্তুতি। আর ওই স্তুতির ভার শেষপর্যন্ত তরুণ সমাজের একটি অংশকে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা গড়তে সহায়তা করেছে। স্তুতির চাপে তার অবদানও মলিন হয়ে গেছে। কিন্তু যদি তার কাজের প্রকৃত মূল্যায়ণ করে লেখা প্রকাশিত হতো তাহলে তা তরুণ সমাজসহ সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য হতো।
সদ্য নির্বাসিত সরকারের সময়ে ইতিহাস চর্চার আরও একটি সমস্যা ছিল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার সহযোদ্ধাদের অবদানকে বেমালুম ভুলে যাওয়া অথবা তাদের অবদানের ইতিহাসকে ঝাপসা করে ফেলা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একা সবকিছু করেছেন বিষয়টি এমন নয়। তিনি ছিলেন নেতা। তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। অন্যদের সহযোগিতায় তিনি তার স্বপ্ন বাস্তবায়িত করে বাঙালিকে মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। যারা তার সহযোদ্ধা ছিলেন তাদেরকে ম্রিয়মাণ করে প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বড় করা যায় না। বরং তার সহযোদ্ধাদের অবদান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সমানতালে চর্চিত হলে বাস্তবে বঙ্গবন্ধু চর্চারও বিকাশ হয়।
জাতীয় চার নেতা, আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা সভাপতি ভাসানী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী, আবুল মনসুর আহমদসহ স্বাধীনতার নানা পর্বে নানা ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান ও দলের যে ভূমিকা ছিল তা তুলে ধরলেই প্রকৃতপক্ষে বোঝা যাবে কীভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সবাইকে ধীরে ধীরে পিছনে ফেলে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু সদ্য নির্বাসিত সরকারের চাটুচার বুদ্ধিজীবী, স্তুতিকারী লেখক-চিন্তকরা ওই প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করতে পারেননি বলেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজও সব মানুষের নেতা হয়ে ওঠেননি। তিনি কেবলমাত্র আওয়ামী লীগের দলীয় ফ্রেমে বন্দি আছেন।
স্তুতি-স্তাবককারীরা কেবল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ফ্রেমবন্দী করে ক্ষান্ত হননি। বরং অন্যদের সম্পর্কে নেতিবাচক কথাও বলেছেন। একজন কলাম লেখক ও মানহীন ইতিহাস বইয়ের লেখক প্রায় বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে নিয়ে অনৈতিহাসিক মন্তব্য করেন। তিনি দাবি করেন, “জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। তিনি পাকিস্তানের এজেন্ট ছিলেন।” ৯৪ সালে বিএনপি সরকার তার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ায় তিনি ক্ষিপ্ত ছিলেন। ওই রাগ-ক্ষোভের বশবতী হয়ে তিনি জিয়াউর রহমান সম্পর্কে অমন অনৈতিহাসিক কথা প্রচার করেছেন। রাজনৈতিক কারণে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা ওই প্রপাগান্ডা মিশ্রিত ইতিহাস গিলেছে এবং একই সুরে সুর তুলে বিগত সময়ে ছন্দ মিলিয়ে গান গেয়েছে। শুধুমাত্র রাজনৈতিকভাবে প্রতিপক্ষ হওয়ার কারণে তারা অমনটি করেছে। কিন্তু যদিও তারা মুক্তিযোদ্ধাদের অবমাননা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির বিষয়ে সোচ্ছার ছিলেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান সম্পর্কে প্রপাগান্ডা ও গুজব প্রচার করলে একজন মুক্তিযোদ্ধার অবমাননা হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বিকৃতি করা হয় সেই বোধ তাদের মধ্যে কাজ করেনি।
একই কথা ভাসানীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়। ভাসানী নভোথিয়েটারের নাম বদলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটার নামকরণ করা হলে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিরা প্রবল প্রতিবাদ করেনি। একটি নভোথিয়েটারের নাম ভাসানী নভোথিয়েটার থাকলে রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের কোনও ক্ষতি হতো না। বরং আওয়ামী লীগ ও তার সরকার প্রশংসিত হতো। বিগত সরকারের সময়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইয়াকারে প্রকাশ করা। ওই বইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাসানীর প্রতি কতটা শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন তা থেকেও স্তুতিকারীরা শিখতে পারতেন। এমনকি তিনি তার প্রতিপক্ষ খুলনার পাকিস্তানপন্থি নেতা খান এ সবুর সম্পর্কে ঐতিহাসিক সত্য উচ্চারণ করেছেন।
প্রতিপক্ষের প্রতি এমন উদারতার উদাহরণও আওয়ামী লীগের তেলবাজদের সহনশীলতা শেখাতে পারেনি।
আওয়ামী লীগের তেলবাজ ও স্তুতিকারীদের মতো একই ভুল করেছে আন্দোলনকারীরা। তারা শেখ হাসিনা সরকারের নির্বাসিত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সড়কের নাম পরিবর্তন করেছে, ধানমন্ডি ৩২ নাম্বার জ্বালিয়ে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কার্য ভেঙেছে।
তাদের ওইসব আচরণ সভ্য ছিল না। হিংস্রতার যে বহিঃপ্রকাশ তারা দেখিয়েছে তা ইতিহাসকে মুছে ফেলার জন্য হলেও প্রকৃতপক্ষে ইতিহাসকে মুছে ফেলা যায় না। ইতিহাস সাময়িক সময়ের জন্য ডুব দিলেও উপর্যুক্ত সময়ে তা আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসে। ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর শুধু বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত বাড়ি নয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এক জীবন্ত দলিল। ওই জাদুঘর বহুবার পরিদর্শনের সুযোগ হয়েছে বলেই ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে জানি বাংলাদেশের ইতিহাস রচনায় তা কতটা দরকারী ছিল। এমনকি বঙ্গবন্ধুকে যারা সমালোচনা করতে চান তাদের জন্যও অতিপ্রয়োজনীয় ঐতিহাসিক উপাদানও ওই জাদুঘরে মজুদ ছিল।
তথ্য-উপাত্ত না পেলে ঐতিহাসিকদের ঐতিহাসিকভাবে নির্মোহ সমালোচনা করাও অসম্ভব। জাদুঘর পুড়িয়ে ফেলে সেই তথ্য-উপাত্ত মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে।
কিন্তু মুছে ফেলতে চাইলেই মুছে ফেলা যাবে না। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান এতটা শক্তিশালী যে তাকে বাদ দিয়ে বায়ান্ন থেকে একাত্তরের সুদীর্ঘ ইতিহাস রচনা করা যাবে না। ১৫ আগস্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে ও ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে লুঙ্গিড্যান্স দিয়ে তাকে অসম্মানিত করার চেষ্টা করা হলেও প্রকৃতপক্ষে এর মাধ্যমে তিনি পুনরায় জীবিত হয়েছেন। ওই দিনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সচেতন মানুষরা ওই লুঙ্গিড্যান্সের প্রতিবাদ করেছেন। মাত্র কয়েকদিন আগে যারা কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নির্বাসনে উল্লাস প্রকাশ করেছেন তাদের অনেকেই ১৫ আগস্টে লুঙ্গিড্যান্স দেওয়া ও ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পুড়িয়ে দেওয়ার নিন্দা করেছেন।
“History Repeats Itself” অর্থাৎ ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না। সদ্য বিদায়ী সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা ইতিহাসের শিক্ষা পথ চলতে কাজে লাগায়নি বলে তাদের দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়েছে। এখন যারা উল্লাস প্রকাশ করে প্রতিপক্ষ দমনে হিংস্রতার পরিচয় দিচ্ছে তাদেরও ইতিহাসের আয়নায় এক সময় নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হতে হবে। মানুষ ক্ষমা করলেও ইতিহাস কখনও মানুষকে ক্ষমা করে না।
পরিশেষে, বাংলাদেশের যে নবযাত্রা শুরু হয়েছে সেই নবযাত্রায় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে সেই চেষ্টা সবপক্ষ করবে বলে আমরা আশা করি। বিএনপিসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিপক্ষের প্রতি সহশীলনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা, রাজনৈতিক সংস্কার ও নিজেদের পুনর্গঠনের যে প্রতিশ্রুতি জাতিকে শুনিয়েছে আমরা তার বাস্তবায়ন দেখতে চাই। নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে সুযোগ সবার সামনে আছে তার সঠিক ব্যবহার করা হলেই কেবল রক্তের ঋণ শোধ হবে। তখনই কেবল নবযাত্রায় নবকল্লোলে নতুন বাংলাদেশ নতুন পথ দেখিয়ে বিশ্বের কাছে রোল মডেল হবে।
লেখক: মো. আবুসালেহ সেকেন্দার, সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
salah.sakender@outlook.com