একটা জাতি রাষ্ট্র বিকাশ, উন্নয়ন সমৃদ্ধিতে জনসম্পৃক্ততা মুখ্য ভূমিকা রাখে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের সংজ্ঞা সেটিই নির্দেশ করে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক গার্নারের মতবাদটি প্রণিধানযোগ্য। তার মতে, রাষ্ট্র হলো কম বা বেশি এমন একটি জনসমাজ, যারা একটি নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস করে, বাইরের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত এবং যাদের একটি সুসংগঠিত সরকার আছে, যার প্রতি অধিকাংশ অধিবাসীই আনুগত্য পোষণ করে। এই মতবাদ বিশ্লেষণে রাষ্ট্রের চারটি মৌলিক উপাদান লক্ষ্য করা যায়, যেমন জনসমষ্টি, নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ড, সরকার ও সার্বভৌমত্ব। এই রাষ্ট্র বিকাশ বা গোড়াপত্তনের জন্য প্রয়োজন জন অনুভূতি ধারণে সক্ষম স্বপ্নদ্রষ্টা বা নেতা বা নেতৃত্ব। তবে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের বিকাশ বা গোড়াপত্তনের ইতিহাস সভ্যতায় ব্যতিক্রম। কেননা ধর্মীয় বিভাজনে জন্ম নেয়া পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র পত্তনের শুরুতেই বাঙালির সঙ্গে যে বিমাতাসুলভ আচরণ হয়েছিল, তার বিপরীতে ভাষাভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির সূচনা, নিয়মতান্ত্রিক স্বাধিকার আন্দোলনে ৩০ লাখ নর-নারীর আত্মত্যাগের পর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়। এর স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন বাঙালির ক্রমবর্তমান ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান উপাদান হলো জনসমষ্টি। জনসমষ্টি ছাড়া রাষ্ট্রকে কল্পনা করা যায় না। বিষয়টি বঙ্গবন্ধু তার নেতৃত্বের গভীরতা দিয়ে অনুধাবন করেছিলেন।
১৯৭৫ সালের মর্মান্তিক ঘটনার পর উল্টোপথে হাঁটা বাংলাদেশকেও জন্ম ইতিহাসের কাছে দায়বদ্ধ করতে তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। বৈষম্যহীন রাষ্ট্রকাঠামো নির্মাণের যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখতেন, সেটির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন বর্তমান বিশ্ব আর্থসামাজিক বাস্তবতায় কতটা সম্ভব, সেটার গভীরে না গিয়ে মোটাদাগে বলা যায়, গত এক যুগেরও বেশি সময়ে বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে বাংলাদেশের মানুষের সামর্থ্য, মাথাপিছু গড় আয় ও আয়ু বেড়েছে, দরিদ্রতা হ্রাস পেয়েছে, নারীর ক্ষমতায়ন বেড়েছে, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কৃষি-শিল্প যোগাযোগ অবকাঠামোর মতো মৌলিক সেবা খাতে রাষ্ট্রের অংশীদারিত্ব বেড়েছে বিস্ময়কর গতিতে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী প্রসারিত হওয়ায় সুবিধা পেয়েছে অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠী। জলবায়ু, জ¦ালানি, মহাকাশবিজ্ঞান- নতুন প্রজন্মের উপযোগী একটি সুস্থ ভবিষ্যৎ নির্মাণের প্রত্যাশায় এসব অপ্রচলিত সম্ভাবনার ক্ষেত্রগুলো উন্মোচিত হয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু টানেল, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ শেখ হাসিনার শাসনকালকে স্মরণীয় করে রাখবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, স্বাধীনতাযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু যে সুযোগ নিজ সাংগঠনিক প্রজ্ঞা ও অন্তরদৃৃৃষ্টি দিয়ে তৈরি করেছিলেন, তা ইতিহাসের আলোকিত অধ্যায় নির্মাণে নির্ণায়ক ভূমিকা রেখেছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি প্রজ্ঞা ও অন্তরদৃষ্টি দিয়ে বঙ্গবন্ধুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে জনকল্যাণে ব্রতী হলেও নগণ্য সংখ্যক সহযোদ্ধার সহচার্য পেয়েছেন।
তারপরও নির্দ্বিধায় বলা যায়- স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি এবং তাদের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে বর্তমান বাংলাদেশের এই যে বিস্ময়কর উন্নয়ন অগ্রগতি- এর নিরঙ্কুশ কৃতিত্ব বা দায় জননেত্রী শেখ হাসিনার। বলা যায়, তার একক নেতৃত্বেই দেশ এগিয়ে চলছে। দার্শনিক সক্রেটিস যথার্থ বলেছিলেন, দেহের সৌন্দর্যের চাইতে চিন্তার সৌন্দর্য অধিকতর মোহময় ও এর প্রভাব জাদুতুল্য। সক্রেটিস বলেছেন, যতদিন লেখাপড়ার প্রতি আকর্ষণ থাকে, ততদিন মানুষ জ্ঞানী থাকে, আর যখনই তার ধারণা জন্মে যে সে জ্ঞানী হয়ে গেছে, তখনই মূর্খতা তাকে ঘিরে ধরে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না- জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গভেদে সমানভাবে গড়ে তোলার মাধ্যমে যে জাতি রাষ্ট্র গড়ে ওঠে, সেই রাষ্ট্রের ভিত্তি অনেক মজবুত হয়। অপরদিকে যে রাষ্ট্র এসব দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় বা এড়িয়ে যায়, সেই রাষ্ট্র মানবসম্পদ তৈরির চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা না করে নানা ধরনের বৈষম্য, বিভাজন, দ্ব›দ্ব-সংঘাত, অন্যায়, অবিচার, ঘুষ-দুর্নীতি অনিয়মকে সমাজ রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সর্বত্র কর্তৃত্ব করার সুযোগ করে দেয়। বাস্তবতা বিবেচনায় আমরা সে দিকে ধাবিত কিনা, সেটি ভেবে দেখা দরকার।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন, সাধারণ জীবনযাপন, জনমতকে প্রভাবিত করার কৌশল, ন্যায়ের সঙ্গে নিবিড় সখ্য কিংবা অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে দৃঢ় অবস্থান, সমাজ রাষ্ট্রের বাস্তবতায় কেন জানি মনে হচ্ছে সেটি আজ ক্রমেই নিষ্প্রভ হয়ে পড়ছে। বঙ্গবন্ধু রাজনীতিকে ত্যাগ ও জনসম্পৃক্ততার দর্শনে প্রতিষ্ঠিত করলেও সময়ের স্রোতে তার অনুসারী হিসেবে পরিচিত অনেক রাজনৈতিক নেতাকর্মী, সমর্থক জীবনাচরণে পার্থিব জগতের প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে। লোভ, স্বার্থপরতা, একাকিত্ব, আদর্শিক শূন্যতা নাগরিক জীবনকে নতুন নতুন সংকটের মুখে এনে দাঁড় করাচ্ছে। আজকাল ভূমিদস্যু, সুবিধাবাদী দুর্নীতিবাজ, অর্থ পাচারকারী, ব্যাংক লুটপাটকারী, সামাজিক স্থিতিশীলতা বিনষ্টকারীদের মুখে সর্বত্র সমুচ্চরে বঙ্গবন্ধু, জয় বাংলা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়টি উচ্চারিত হচ্ছে অথচ বঙ্গবন্ধুর জনকল্যাণকামী ত্যাগের রাজনীতিতে ক’জনকে খুঁজে পাওয়া যাবে? বাহ্যিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীর সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পেলেও মনেপ্রাণে বঙ্গবন্ধু ও জননেত্রী শেখ হাসিনাকে ধারণ করেন, সেই সংখ্যা কি অনেক বেশি? ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছে অনুপ্রবেশকারী।
মর্মান্তিক ’৭৫-পরবর্তী রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক ভিত্তি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ওয়ার্ড, ইউনিয়ন পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত দলীয় পদ-পদবি পেতে বিশাল অঙ্কের লেনদেন সংঘটিত হয়েছে, যা আজ অধিকারে রূপ নিয়েছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতি জনকল্যাণে নিবেদিত না হয়ে ব্যক্তিকল্যাণে সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। অনেকের মতে জনকল্যাণের রাজনীতি বাণিজ্যিক ভিত্তি গড়ে উঠছে। এই চাঁদাবাজির বাণিজ্য শুধু দলীয় রাজনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে তা শ্রমজীবী, কর্মজীবী, পেশাজীবী সংগঠনগুলোর মধ্যে বিস্তৃত হচ্ছে। শোনা যায় ছাত্র সংগঠনগুলোর কমিটি অনুমোদনের ক্ষেত্রেও বিস্তৃত হচ্ছে চাঁদার পরিমাণ। রাজনীতি, সংগঠন, দলীয় পদ-পদবি ব্যবহার করে এক শ্রেণির মুখোশধারী চেতনাধারীরা গাড়ি, বাড়ি, বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাংক, ইনস্টিটিউটের মালিক বনে যাচ্ছেন। তাই রাজনীতির প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা বিশ্বাস হ্রাস পাচ্ছে। এতে একটি গণতান্ত্রিক জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রের অগ্রগমন শুধু ব্যাহতই হচ্ছে না, বরং জনগণকে জনস্বার্থবিরোধী উচ্ছৃৃঙ্খলতার দিকে ধাবিত করছে।
মহামান্য রাষ্ট্রপতি ২০২৩ সালের প্রথম সংসদ অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণে বলেছেন, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, মাদক ও জঙ্গিবাদ সম্পূর্ণরূপে নির্মূলের মাধ্যমে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতিকে অধিকতর ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, স্বাধীন-সার্বভৌম এ দেশে জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। তাই জনগণকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে। বঙ্গবন্ধুর জনসম্পৃক্ত রাজনৈতিক কৌশল ও প্রজ্ঞাবান সহচার্যদের রাজনৈতিক নীতিদর্শনের কাছে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র কখনোই উপনিবেশিক মানসজাত কর্তৃত্ব প্রদর্শনের সাহস দেখাতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু অকপটেই তাদের স্মরণ করে দিয়েছিলেন, সবাই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, জনগণের প্রভু নন, জনগণই রাষ্ট্রের মালিক।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে লক্ষ্য করা যায়- সেসব প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন ২/১ জন কর্তা ব্যক্তির ঊর্ধ্বতন ও সরকারি নিয়ম-শৃঙ্খলার পরিপন্থি কার্যক্রমের পরিপ্রেক্ষিতে স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতিসহ নানা জনস্বার্থবিরোধী সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। ফলে একদিকে প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে সরকারকে সেসব অপকর্মের দায় নিতে হচ্ছে। সুশিক্ষা, সুশাসনের স্বার্থে রাষ্ট্রের অপরিহার্য প্রাতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। সরকার ও জনমানুষের মাঝে যে ক্ষমতার কৃত্রিম দেয়াল সৃষ্টি হয়েছে, তা বঙ্গবন্ধুর সত্যিকার রাজনৈতিক চর্চা দিয়ে ভেঙে দিতে হবে। সুন্দর আগামীর জন্য জনগণের ক্ষমতার বিকাশ ঘটাতে হবে। ভোগবাদের দুষ্টচক্র যেভাবে সামাজিক মূল্যবোধ ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভেঙে দিচ্ছে, সেটি সুন্দর আগামীর জন্য সুখকর বার্তা বয়ে আনবে না। আমাদের অবশ্যই রাজনৈতিক আবরণে ভোগের নেশা থেকে প্রজন্মকে মুক্ত করতে হবে। রাষ্ট্রটি শুধু বিশেষ সুবিধাবাদী শ্রেণির নয়, এটা গণমানুষের রক্ত ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত পবিত্র ভূ-খণ্ড। যে কাঠামো জনমানুষের সমাধিকার প্রতিষ্ঠায় সুশাসন নিশ্চিতে সাংবিধানিকভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ। সেই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সুবিধাবাদী রাজনীতির দুষ্টচক্র থেকে সমাজ রাষ্ট্রকে রক্ষা করতে হবে। দায় এড়ানো নয়, জবাবদিহিতা সুনিশ্চিতে রাষ্ট্রকেই পরিচ্ছন্ন অঙ্গীকার নিয়ে জনগণের পাশে দাঁড়াতে হবে। যেখানে পেশিশক্তির প্রাধান্য বাদ হয়ে মেধাভিত্তিক কর্মশক্তি রাষ্ট্র সমাজের নিয়ামক শক্তিতে পরিণত হবে। আশা করছি, বঙ্গবন্ধুর পাহাড়সম সততা, উজ্জ্বল ও দূরদর্শী রাজনৈতিক আদর্শবলে বলীয়ান হয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা সমাজ রাষ্ট্রে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালনে কঠোর হবেন। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এই প্রত্যাশা অনুধাবনে ব্যর্থ হলে স্বাধীনতা বিপন্ন হবে। যার দায় বর্তমান প্রজন্ম এড়াতে পারবেন না।
এ কে এম এ হামিদ : উন্নয়ন গবেষক ও সভাপতি, আইডিইবি।
gs.ideb.cec@gmail.com