মিলিন্দা বন্দ্যোপাধ্যায় : সাম্প্রতিককালে আপনি ইংরেজি থেকে বাংলায় লেখার দিকে ঝুঁকেছেন, আবার এই লেখাগুলো স্পষ্টতই দর্শন-ভিত্তিক। এর কারণ কী?
রণজিৎ গুহ : আমি সবসময়ই বাংলা ভাষাকে ভালোবাসি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছেন। শুধুমাত্র তার সর্বজনস্বীকৃত প্রতিভার কারণেই নয়, তার বিশ্বদর্শনের কারণেও। তাই আমি বাংলায় লেখার তাড়না অনুভব করেছি এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সংস্পর্শে আসতে চাচ্ছি৷
মিলিন্দা : আপনার ওপর রবীন্দ্রনাথ বা বাংলা সাহিত্যের প্রভাব সবসময় ছিল? নাকি পরিণত বয়সে এসে আপনার মনোজগতে স্থান করে নিয়েছে?
রণজিৎ : আমার যৌবনেও আমি এসবের সাথে জড়িত ছিলাম; তবে তখন বিষয়গুলো আমার চোখে স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি, বরং, আমার আগ্রহ ছিল গরিবদের জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার প্রতি, তাই আমার কাছে মার্কসবাদ তখন বেশ আকর্ষণীয় ছিল। পূর্ববঙ্গের বরিশালের একটি খাস তালুকদার পরিবার থেকে আমি উঠে আসি, তাই জমিদার-প্রজা সম্পর্কের কাঠামো সম্পর্কে আমি ভালোভাবেই অবহিত ছিলাম, যা আমার মনে গভীর ছাপ ফেলে। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে থাকাকালীন আমি মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হই এবং কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেই। ৪০-এর দশকের শেষের দিকে আমি উল্লেখযোগ্য একটা সময় ইউরোপে কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে কাজ করে কাটাই। তবে সেইসময় আমি ধীরে ধীরে কমিউনিস্ট পার্টির মার্কসবাদ থেকে দূরে সরে যাই। পূর্ব ইউরোপের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় সোভিয়েত ইউনিয়ের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা, ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার জন্য কোন্দল, হাঙ্গেরিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের আক্রমণের জের ধরে আমি কমিউনিস্ট পার্টি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। পরে আমি একজন নকশাল বুদ্ধিজীবীর মতো কিছু একটা হয়ে উঠি। আমি নিজেকে চারু মজুমদারের ধ্যান-ধারণার শিষ্য মনে করি। আমার মনে হয় এই ধারণাগুলো অনেক বেশি ন্যায় ও প্রাসঙ্গিক। তবে, চারু মজুমদার ও তার অনুসারীরা সাংগঠনিক দিক থেকে অনেক দুর্বল ছিল, তাই আন্দোলনটি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। ইন্দিরা গান্ধির সময়কার বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা নিয়েও আমি নিন্দা করেছি, যারা বিদ্রোহ দমনে ইন্দিরার কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দিয়েছিল এবং তার অনেক নিন্দিত কাজকেই প্রসংশায় ভাসিয়েছিল। যেমন, জরুরি অবস্থাতেও ট্রেন সময়মতোই চলবে। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি যে মার্কসবাদী মতবাদ ধারণ করতো তা প্রকৃত মার্কসবাদী দর্শন থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। মার্কসবাদ নিয়ে তাদের ধারণা ছিল খুব সাধারণ এবং তাদের অধিকাংশই মূল বইগুলো পড়েনি। প্রচলিত এই মার্কসবাদী মতবাদ আমাকে মার্কসের দার্শনিক দ্বন্দ্ব ও জটিলতা অন্বেষণ করতে প্ররোচিত করেছিল, যা আমাকে হেগেল অব্দি পৌঁছিয়ে দেয়। হেগেল আমাকে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন৷
মিন্দিলা : কিন্তু আপনি তো আপনার বই ‘History at the limit of world history’-তে হেগেলের সমালোচনা করেছিলেন।
রণজিৎ : আমি তাকে সামগ্রিকভাবে সমালোচনা করিনি, তার দর্শনের কিছু নির্দিষ্ট উপাদানের সমালোচনা করেছি। বিশেষ করে, তার দর্শন মোটামুটি ইউরোপকেন্দ্রিক; যা তার সমসাময়িক সবার মাঝেই কমবেশি ছিল। কিন্তু হেগেলের ‘Geist’-এর ধারণা এবং এর মধ্যে নিহিত উত্তরণের আবহ এখনো গুরুত্বপূর্ণ। একটি self, social self তৈরি করার ক্ষমতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মিন্দিলা : এই উদ্বেগ কি সাবঅল্টার্ন স্টাডিজ কালেক্টিভের বাকি সবার মধ্যেও উদিত হয়েছে, নাকি আপনিই এর প্রসার ঘটিয়েছেন, যেহেতু উত্তরণের বিষয়টি আপনার তরুণ সমসাময়িকদের ‘পোস্টস্ট্রাকচারাল’ বা ‘পোস্টমডার্ন’ দৃষ্টিকোণ থেকে নেতিবাচকভাবে দেখা হয়। বিশেষভাবে বললে, বর্তমান সময়ের প্রবণতাই হচ্ছে সকল ন্যারেটিভকে সন্দেহের চোখে দেখা।
রণজিৎ : আমি মনে করি উত্তরণ বা এ ধরনের বিষয়ে আমার বিশ্বাস আমাকে খানিকটা অনন্য করে গড়ে তুলেছে। হেগেলিয়ান উত্তরণকে সংকীর্ণ বা এটি নির্ধারক পদ্ধতিতে কাজ করে—এমন কিছু ভাবা ভুল হবে যা অনেক পণ্ডিতরাই করেছেন। বরং, হেগেল ‘Geist’-এর আন্দোলনের যে ধাপগুলো বর্ণনা করেছেন সেগুলোকে মানব সমাজের সাপেক্ষে সংকীর্ণভাবে না দেখে, সেগুলোকে আদর্শ ও উদাহরণ হিসেবে দেখা উচিত। পাশাপাশি হাইডেগারের ‘Phenomenological’ দৃষ্টিভঙ্গিও আমার ওপর গভীর ছাপ ফেলেছে। আমি ‘being’ এবং ‘becoming’ দুটোই গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। কান্ট এবং নিৎশেও আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। হাইডেগারের মাধ্যমে আমি থমাস একুইনাসের সাথেও পরিচিত হই। গ্রিকদের মধ্যে, আমি ‘Phenomenological totality’-এর উপলদ্ধির ক্ষেত্রে এরিস্টটলকে প্লেটোর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ মনে করি।
আমার মতে বুদ্ধিবৃত্তির ইতিহাস ও ধারণার ইতিহাস অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমার প্রথম কাজ ছিল বাংলায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বুদ্ধিবৃত্তিক উৎসের ওপর—সাম্প্রতিক বাংলা বইয়ে আমি এই বিষয়ে লিখেছি। আমার ‘Elementary Aspects of Peasant Insurgence in India’ বইটি নানা সংরক্ষিত উৎস থেকে পাওয়া বিভিন্ন ধারণা নিয়ে কাজ করেছে। আমি দর্শনের উপর জোর দেই কিন্তু সেই দর্শন হতে হবে ইতিহাসবিদদের দ্বারা লিখিত বা সংরক্ষিত উৎস থেকে সংগ্রহীত—যা আমাদের কৃষকদের মানসিকতা বুঝতে সাহায্য করবে। আমার পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী কাজগুলোকে যা সজীব করে তোলে তা হচ্ছে পরিপূর্ণতার অনুসন্ধানের দার্শনিক প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ। মানুষ অপূর্ণ, কিন্তু সে সবসময় পরিপূর্ণতার সন্ধান করে। কখনো সে এটা করে প্রকৃতি ও অন্যান্যদের পরাজিত করে, ধ্বংস করে, আবার কখনো নতুন জিনিস সৃষ্টি করে সে পরিপূর্ণতা অর্জন করতে চায়। তাই মানুষ যখন দেখে পাখি উড়তে পারে, মাছ পানির নিচে থাকতে পারে কিন্তু সে এগুলো পারে না, তখন সে উড়োজাহাজ ও সাবমেরিন তৈরি করতে অনুপ্রাণিত হয়৷ পরিপূর্ণতার জন্য এই অনুসন্ধান মানুষের ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষাকেও সজীব করে। আমার কাছে এটি অধ্যায়নের একটি প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, মানুষের ভেতর অণুবিদ্ধ ন্যায়বিচারের ধারণাকে অধ্যায়ন করা যা আমরা কৃষক বিদ্রোহ ও প্রচলিত ধর্ম ব্যবস্থায় দেখি। প্রচলিত ধর্মে ন্যায়বিচারের ধারণা আমাকে সর্বদা গভীরভাবে তাড়িত করেছে। এই পরিপূর্ণতার ধারণাই উত্তরণ ও আত্মের পরবর্তী ধাপে পৌছানো—এ ধরনের ধারণাগুলোকে প্রাসঙ্গিক রেখেছে।
মিন্দিলা : পরিপূর্ণতা খোঁজা নিয়ে অস্পষ্টতা—এই যে কেউ অন্যকে ধ্বংস করতে চাচ্ছে, আবার কেউ অন্যকে কাছে টেনে নিতে চাচ্ছে—আপনার এই মতামত কি হেগেলীয় প্রভু-দাস দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের সাথে সম্পর্কিত?
রণজিৎ : হ্যাঁ। এবং এই দ্বান্দ্বিকতা বোঝার চেষ্টা আমাকে সবসময় নাড়া দিয়েছে। আমি একটি বৌদ্ধ পাঠ্যবই থেকে এই দ্বান্দ্বিকতাকে উল্লেখ করে এমন একটি উদ্ধৃতি খুঁজে পেয়ে বেশ আনন্দিত হয়েছিলাম। এই উদ্ধৃতি আমি আমার ‘Elementary aspects of peasant insurgence’ বইয়ের প্রারম্ভিক উদ্ধৃতি হিসেবে ব্যবহার করেছি।
মিলিন্দা : আপনি কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন? কেননা, উত্তরণের সম্ভাব্যতা স্বীকার করলে ঈশ্বর বা এধরনের সত্তার অস্তিত্ব স্বীকার করা গুরুত্বপূর্ণ।
রণজিৎ : আমি ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করি কি না—এই প্রশ্নের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ আমি ঈশ্বরের ধারণায় বিশ্বাস করি কি না। আমি এই ধারণা বিশ্বাস করি এবং মনে করি এই বিশ্বাস অপরিহার্য, কেননা এই বিশ্বাস মানুষকে প্ররোচিত করে নিজেকে ছাড়িয়ে পরিপূর্ণতা ও ন্যায়বিচারের খোঁজ করতে, এ পৃথিবীতে যা সে খুঁজে পায় না তা সৃষ্টি করতে। এই প্রচেষ্টা অধ্যায়ন করার জন্যই আমি ভারতীয় দর্শনের সাথে যুক্ত হয়েছি, যুক্ত হয়েছি ভর্তৃহরি, অভিনবগুপ্ত বা শঙ্করাচার্যের মতো চিন্তাবিদদের সাথে। ভারতীয় দর্শন সর্বদা এই বিষয়বস্তুর ওপর আবর্তিত হয়েছে। আধুনিক ভারতীয়রা দুঃখজনকভাবে নিজেদের ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও ভারতীয় দর্শনের অত্যন্ত সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে অবহেলা করে আসছে। আমার সাম্প্রতিক কাজগুলো, যেগুলো আমি বাংলায় ভারতীয় দর্শনের ওপর ভিত্তি করে লিখেছি, আমি সবাইকে এই ধারণাগুলোতে ফিরে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা মনে করিয়ে দিতে চাই। বিশেষত, আত্মর সাথে অন্যদের সম্পর্ক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এবং এই কাজগুলোতে দৃঢ়ভাবে উচ্চারিত হয়। নিজের আত্মার বাইরে যাওয়া, নতুন আত্মা গ্রহণ করার ক্ষমতা, অন্যের কাছে পৌঁছানোর, উত্তরণের ক্ষমতা—এই বিষয়গুলো সাহিত্যেও দৃশ্যমান, তা হোক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাজে অথবা নতুন কোনো কবির কাজে। সাহিত্য আমাদের জীবন সম্পর্কিত নানা উপলব্ধি দান করে এবং আধুনিক ভারতীয় সাহিত্যিকরা এসব উপলব্ধি বিশ্লেষণের নতুন উপায় খুঁজে পেতে সামর্থ্য হয়েছেন, যা ইতিহাস বা ইতিহাসবিদরা কখনোই স্পষ্ট করে বলে যেতে পারেননি। ভারতীয় সাহিত্য ও দর্শন পর্যালোচনা করে এর গভীরে গেলে এই উপলদ্ধিগুলো পুনরুদ্ধার করা যেতে পারে এবং নতুন প্রজন্মের বিবর্ণ চোখধারী পণ্ডিতদের দিয়ে ব্যবহার উপযোগী করা যেতে পারে। কান্ট এবং হেগেলের জার্মান আদর্শবাদী দর্শন যে উদ্বেগগুলিকে প্রকাশ করেছে তা পূর্বেই ভারতীয় দর্শনে প্রকাশিত ছিল। এই বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলার জন্য একটি নির্দিষ্ট গ্রন্থগত বা ধারণাগত ভাষা প্রয়োজন, যা অনেকের জন্য বোঝা কষ্টকর। কিন্তু আমি সর্বদা নিজেকে প্রকাশ করার জন্য, নিজেকে সন্তুষ্ট করার জন্য লিখেছি, কোনো তাৎক্ষণিক স্রোতার কথা মাথায় রেখে নয় যার জন্য আমাকে সহজ ও বোধগম্য উপায়ে লিখে লেখার ভার কমাতে হবে।
আমি আনুষ্ঠানিকভাবে আমার মৃত্যুর পর, আমার সমস্ত ব্যক্তিগত কাগজপত্র এবং বই ভিয়েনার অস্ট্রিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সে দান করার জন্য একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছি। এর মধ্যে আমার ও অন্যান্য নিম্নবর্গ অধ্যায়ন পণ্ডিতদের মধ্যে আদান-প্রদান করা অনেক চিঠিসহ নানা উপকরণ রয়েছে যা ‘Subaltern Studies Collective ‘-এর ইতিহাস রচনার জন্য একেবারে অপরিহার্য। এই ‘Subaltern Studies Collective’ সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের ইতিহাস রচনায় সবচেয়ে মৌলিক অবদান রেখেছে। যদি হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটির বিশেষজ্ঞরা ভবিষ্যতে এখানে এসে এসব নিয়ে কাজ করে তাহলে খুব ভালো হবে।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : মিলিন্দা বন্দ্যোপাধ্যায়