স্কুলের গন্ডির বাইরে বিশেষ দিনগুলো ছাড়া সচরাচর জোর গলায় জাতীয় সঙ্গীত গাইতে দেখা যায় খেলোয়াড়দের। যে কোনও আন্তর্জাতিক ম্যাচ শুরুর আগে আমরা দেখি আমাদের লাল-সবুজ জার্সি পরা বাঘ ও বাঘিনীরা আবেগ নিয়ে দলবদ্ধভাবে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত গাইছে। মাঠে উপস্থিত দর্শকের মাঝেও সেই আবেগ ছড়িয়ে যায় নিমেষেই।
২০১৮ সালে ইউরোপিয়ান জার্নাল অব স্পোর্টস সায়েন্সে প্রকাশিত একটি গবেষণায় উঠে এসেছে একটি দারুণ তথ্য। গবেষণাটি বলছে, কোনও প্রতিযোগিতামূলক খেলায়, ম্যাচ শুরুর আগে জাতীয় সঙ্গীতের সময় প্রদর্শিত দলের আবেগ ম্যাচে ওই দলের সাফল্যের সাথে জড়িত।
এই গবেষণাটি ইউরো ২০১৬ টুর্নামেন্টের ৫১টি খেলায় জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সময় দলের সদস্যদের মধ্যে যে আবেগ দেখা যায় এবং দলের কর্মক্ষমতা বা পারফরম্যান্সের মধ্যে কোনও সংযোগ আছে কিনা তা পরীক্ষা করে এবং পজেটিভ কানেকশন বা ইতিবাচক সংযোগ দেখতে পায়।
গবেষণায় বলা হয়, সামাজিক পরিচয় তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে গড়ে তোলা এই গবেষণায় দেখা গেছে, যে দলগুলো ভীষণ আবেগের সাথে ম্যাচের শুরুতে জাতীয় সঙ্গীত গেয়েছে ওই ম্যাচে তারা তূলনামুলক কম সংখ্যক গোল খেয়েছে।
এর পিছনের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে গবেষণাপত্রটি বলছে, একসাথে একটি জাতীয় সঙ্গীত গাইবার কারণে দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে একটি সোশ্যাল আইডেন্টিটি কনসেপ্ট কাজ করে যা ম্যাচে তাদের পারফর্মেন্সকে প্রভাবিত করে। খেলোয়াড়রা ম্যাচটাকে কেবল একটা খেলা নয় বরং প্রতিপক্ষের দলকে দেখে আমরা বনাম ওরা হিসাবে।
এ তো গেলো আবেগ দিয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার গল্প। জাতীয় সঙ্গীত না গেয়ে নিরব দাঁড়িয়ে থেকেও যে সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করা যায় তার উদাহরণ ও আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে আছে।
২০২২ এর বিশ্বকাপ ফুটবলের ইরান আর ইংল্যান্ডের মধ্যকার ম্যাচের শুরুতে ইরানের পুরো দল জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া থেকে বিরত থাকে। ওই সময়ে ইরানের সিকিউরিটি ফোর্স কুর্দি অধ্যুষিত শহরগুলোতে গুলি চালাচ্ছিলো আন্দোলনকারীদের ওপর। এরই প্রতিবাদ ছিল আন্তর্জাতিক ক্রীড়া পরিমন্ডলে ইরান ফুটবল দলের জাতীয় সঙ্গীত না গাওয়া যা বিশ্ব মিডিয়ার নজরে আসে সাথে সাথেই। পুরো স্টেডিয়াম জুড়ে ইরানের সমর্থকরা ও বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড হাতে দলের সাথে এই প্রতিবাদে অংশ নেয়।
মোটামুটি বলা যায়, দেশ কিংবা বিদেশে জাতীয় সঙ্গীত আজ কেবল সরকারি বিশেষ দিনগুলোতে আর খেলাধুলার ইভেন্টগুলোতে ব্যবহৃত হয়, বিশেষ করে অলিম্পিক গেমসে, যেখানে প্রতিটি ইভেন্টের বিজয়ীকে সে যে দেশের প্রতিনিধিত্ব করে তার পতাকা এবং জাতীয় সঙ্গীত দিয়ে অভিবাদন জানানো হয়। তবে গভীরভাবে চিন্তা করলে আমরা দেখবো জাতীয় সঙ্গীত হলো কোনও দেশের সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক ইতিহাসের জানালা; যে জানালা দিয়ে তাকালে ওই দেশের সংস্কৃতি, দেশের মানুষ, তাদের আশা আত্মত্যাগকে জানা যায়।
জাতীয় সঙ্গীত সাধারণত দেশের সরকার দ্বারা স্বীকৃত হয়, অর্থাৎ তাৎপর্য বিবেচনায় কোনও সঙ্গীতকে দেশের সরকার জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা দেয়। আবার বহুল জনপ্রিয় কোনও গান জনগণের বহুল ব্যবহারের মাধ্যমে ও জাতীয় সঙ্গীতে রূপান্তরিত হতে দেখা যায়। ফ্রান্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ অনেক পুরনো জাতীয় সঙ্গীত রচিত হয়েছিল জাতির ক্রান্তিকালে একটি জাতির সংকল্পকে শক্তিশালী করার জন্য জাতীয় সঙ্গীতের যে শক্তি তার প্রমাণ দেখতে পাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন মিত্রশক্তির জাতীয় সঙ্গীতের লন্ডন থেকে বিবিসি-এর সাপ্তাহিক সম্প্রচার ইউরোপ জুড়ে লক্ষ লক্ষ দর্শকদের আকর্ষণ করেছিল।
একই ভাবে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে আমার সোনার বাংলা সহ আরও অনেক দেশাত্মবোধক ও প্রতিবাদী গান সম্প্রচার করা হতো যা মুক্তিকামী বাংলার জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলো।
(১৯৭০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চিরসবুজ সিনেমা ‘জীবন থেকে নেওয়া’-তে আমার সোনার বাংলা এই গান ব্যবহৃত হয়। এটি কোনো সিনেমায় এই গানের প্রথম ব্যবহার। জহির রায়হান নির্মিত এই সিনেমায় তৎকালীন বাঙালি স্বাধীনতা আন্দোলনকে রূপকের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়।)
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের আগে গানটির পুনরুজ্জীবন ঘটে। মুজিবনগরে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার এই গানকে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। অথচ, সাম্প্রতিক সময়ের সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ হলো, বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতকে ‘স্বাধীনতার অস্তিত্বের পরিপন্থি’ আখ্যা দিয়ে তা পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমের ছেলে আব্দুল্লাহিল আমান আযমী।
আমান আযমীর এই মন্তব্যের পর পুরো দেশজুড়ে বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে। কালক্ষেপন না করে গত মঙ্গলবার থেকেই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে নিজেদের স্কুল জীবনের এসেম্লিতে গাওয়া আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি – নিয়ে ছেলেবেলার মধুর স্মৃতিকথন আর স্মৃতিকাতর হতে দেখা গেছে বুমার, মিলেনিয়াল সহ জেন-জি দেরও।
এখানে অবশ্যই উল্লেখ করা দরকার যে, এবার প্রতিবাদ যারা করছে তারা অনেকেই বলছে আমরা গত জুলাই- আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সে নতুন সাম্যের বাংলাদেশ চেয়েছি, সেই বাংলাদেশে সবার বাক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার কথাও বলেছি। সুতরাং, কারো কোনও চিন্তা বা কথা পছন্দ না হলে, প্রতিবাদ হবে অবশ্যই তবে তা কারো বাক স্বাধীনতা হরণ করে নয়।
এদিকে, ব্যক্তিগত পর্যায়ে কেবল নয় সমষ্টিগত ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে অফলাইনেও। ব্যক্তি ও শিল্পীরা জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের এই দাবিকে দেখছেন বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত ষড়যন্ত্র হিসাবে।
গত শুক্রবার জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের “ষড়যন্ত্রের” বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও প্রতিবাদী গান গেয়ে ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীরা।
একটা দারুণ তথ্য দেই এখানে।
২০১২ সালের লন্ডন অলিম্পিকের সময় ২০৫টা দেশের জাতীয় সঙ্গীত বাজানোর জন্য প্রস্তুত রাখা হয়। ওই সময় সব দেশের জাতীয় সঙ্গীত ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুনে আর বিশ্লেষণ করে ‘দ্য আর্ট ডেস্ক’ শীর্ষ তালিকা তৈরি করেছিল। ‘আর্ট ডেস্ক’ সঙ্গীত ও শিল্পকলাবিষয়ক প্রকাশনা, যাতে টেলিগ্রাফ, ফিন্যান্সিয়াল টাইমস, ইকোনমিস্টের লেখকেরা যুক্ত। আর্ট ডেস্কের প্রতিষ্ঠাতা ইসমেন ব্রাউনের নিজের নামেই পৃথিবীর সেরা জাতীয় সঙ্গীতগুলোর তালিকাটি প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁদের মতে, সেরা ১০ স্বর্ণপদকজয়ী জাতীয় সঙ্গীত হলো রাশিয়া, ইতালি, জাপান, বাংলাদেশ, জ্যামাইকা, ইসরায়েল, ফ্রান্স, হাঙ্গেরি, ক্যামেরুন ও বুলগেরিয়া।
তালিকার কথা যখন উঠলোই তখন বিশ্বের কয়েকটি দেশের জাতীয় সঙ্গীতের দিকে একটু তাকানো যাক।
সবচেয়ে পুরনো জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে কথা বলতে গেলে ব্রিটেন, নেদারল্যান্ডস এবং জাপানের নাম উঠে আসে। জাতীয় সঙ্গীত বা ন্যাশনাল এন্থেমের ধারণার শুরু হয় আঠারো শতকে হলেও মূলত উনিশ শতকে এসে জাতীয়তাবাদের ধারণা ক্রমবিকাশের সাথে সাথে ইউরোপ ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে জাতীয় সঙ্গীতের ধারণা প্রসার ঘটে। এর আগে বিভিন্ন দেশ, জনপদের মানুষ সম্মিলিতভাবে যা গাইতো তা মূলত রাজার বন্দনাগীত বা রয়াল এন্থেম।
ব্রিটেনের জাতীয় সংগীত হলো God save the king যার বাংলায় অর্থ দাঁড়ায় স্রষ্টা রাজাকে রক্ষা করুন।
ব্রিটিশ এই জাতীয় সঙ্গীতে দেশ, দেশের মানুষ, তাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি বা ব্রিটিশদের আশা আত্মত্যাগ এসবের কিছুই নেই। এটা মূলত একটা প্রার্থনা সঙ্গীত। তারপর আবার এই সঙ্গীত রাজা বা রানীর পরিবর্তনের সাথে সাথে বদলে যায়।
দুই বছর আগে রানীর মৃত্যুতে গত দুই বছরে এই সঙ্গীত এখন গড সেইভ দ্য কিং মানে স্রষ্টা রাজাকে রক্ষা করুন হয়ে গেছে। কারণ রানী এলিজাবেথের মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেছেন তার ছেলে তৃতীয় চার্লস।
৭৩ বছরের প্রিন্স অবশেষে রাজ সিংহাসনে তো বসলো কিন্তু এখনও ব্রিটেনের জনগণ তাকে যখন তখন রাজা না বলে প্রিন্স চার্লস বলে বসে, এমনকি তার সামনেও। জনগণের আর কী দোষ! ৭৩ বছর একটা লম্বা সময় কোনও অভ্যাস গড়ে ওঠার জন্য। আর সেই অভ্যাসের কারণেই হরহামেশাই এখানের মানুষ এখনও ভুল করে রাজার বন্দনার বদলে গড সেইভ দ্য কুইন গেয়ে বসছে জাতীয় সঙ্গীতে।
লন্ডনের আর্ট ডেস্ক অবশ্য বহু প্রাচীন ব্রিটেনের এই জাতীয় সঙ্গীতকে রেখেছে খারাপের তালিকায়। এদিকে গাইতে গেলে বেগ পেতে হয় এমন কঠিন জাতীয় সঙ্গীতের তালিকা করলে একেবারে উপরের দিকে থাকবে যুক্তরাষ্ট্র বা ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকার জাতীয় সঙ্গীত “The Star-Spangled Banner”। ব্রিটেনের মতো আমেরিকার এই জাতীয় সংগীত কোনও রাজা বা রানীর বন্দনা করে নয় বরং জাতীয় পতাকাকে নিয়ে লেখা একটি কবিতা। আরেকটি মজার তথ্য হলো, ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতা পাওয়া আমেরিকার জাতীয় সঙ্গীতের সুর এসেছে বহু পুরনো ইংরেজ পানশালায় প্রচলিত একটি গান থেকে। একে তো মদের দোকানে গাওয়া গান, তার ওপর সে গান আবার ইংরেজ শাসকদের মনে করিয়ে দেয়!
“আমার সোনার বাংলা” কিন্তু এমনি এমনি আমাদের জাতীয় সঙ্গীত হয়ে যায়নি। “আমার সোনার বাংলা” রবীন্দ্রনাথের এই গানকে যখন জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গ্রহণ করার চিন্তা করা হয় তখন একই সাথে আরও দুটো গানের কথা উঠে এসেছিলো আলোচনায়। তাদের একটি হলো দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রচিত ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ এবং কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল’। পরবর্তীতে ‘চল চল চল’ গানটি আমাদের রণ সঙ্গীত হিসাবে গৃহীত হয় আর রবি ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’কে নির্ধারণ করা হয় আমাদের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে।
‘ধন ধান্য পুষ্পভরা’ গানটি কেন আমাদের জাতীয় সঙ্গীত হতে পারে না এমন প্রশ্নও উঠেছে এ সপ্তাহে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে। ‘ধন ধান্য পুষ্পভরা’ গানটি খুবই শ্রুতিমধুর। বিশেষ করে গানের কয়েকটা লাইন যেমন ‘ভাইয়ের মায়ের এত স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ’, আবার ‘ও সে, স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে-দেশ, স্মৃতি দিয়ে ঘেরা’; আমাদের বাংলাদেশের মানুষ আর তাদের ইতিহাসকে কী দারুণ করে ফুটিয়ে তোলে। তবে এই গানেরই একটি লাইন যা ঘুরে ফিরে বারবার গানটিতে এসেছে তা হলো – ‘সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি’। গানের এই কথাগুলো প্রকট জাতীয়তাবাদ আর উৎকট স্বাদেশীকতায় দুষ্ট!
প্রকট জাতীয়তাবাদের প্রসঙ্গে “Song of the Germans,” বা জার্মানির জাতীয় সঙ্গীতের কথা এসে যায়। জার্মান জাতীয় সঙ্গীতের প্রথম শ্লোক, “Deutschland, Deutschland über alles” (জার্মানি, জার্মানি সবার উপরে), দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে এবং বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়কালে জার্মান জাতীয়তাবাদ এবং সামরিকতাবাদের সাথে যুক্ত থাকার কারণে বিতর্কিত হয়েছে।
“জার্মানি সবার উপরে ” গানটি যদিও মূলত উনিশ শতকে জার্মান ঐক্যের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছিল, ‘জার্মানি সবার উপরে’ এই অনুভূতিটি পরবর্তীতে নাৎসিদের হাতে জার্মান শ্রেষ্ঠত্ব এবং সম্প্রসারণবাদের চরম রূপ প্রচার করতে ব্যবহৃত হয়েছিল।
ফলস্বরূপ, এই সঙ্গীতের প্রথম স্তবকটি দেশের ফ্যাসিবাদ ও আগ্রাসনের অন্ধকার ইতিহাসের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে আবদ্ধ হয়ে উঠেছে। তাই বর্তমান জার্মানির জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে প্রথম ও দ্বিতীয় স্তবক বাদ দিয়ে কেবল তৃতীয় স্তবক গাওয়া হয়।
এ পর্যায়ে এসে প্রশ্ন উঠতে পারে, জাতীয় সঙ্গীত কি কখনই পরিবর্তন করা যায় না?
হ্যাঁ যায়, জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের ইতিহাস পৃথিবীতে আছে। জার্মানির কথা তো মাত্র বললাম। কেবল জার্মানি নয়, বিশ্বের আরও কয়েকটা দেশ দিন বদলের সাথে নতুন নতুন ধারণা ও ত্বত্ত্বকে ধারণ করে নিজেদের জাতীয় সঙ্গীতে কিছুটা পরিবর্তন এনেছে। বিশেষ করে কানাডা এবং অস্ট্রিয়ার কথা বলা যায় যেখানে লিঙ্গ সমতা ও লিঙ্গ নিরপেক্ষ ধারণা ও আইনের প্রচলন ও প্রসার ঘটায় মূল জাতীয় সঙ্গীতকে সামান্য পরিমার্জন করা হয়েছে।
লিঙ্গ সমতা আনার জন্য অস্ট্রিয়ার জাতীয় সঙ্গীতে ‘ছেলেরা’-এর জায়গায় ‘মেয়েরা এবং ছেলেরা’ লেখা হয়েছে। এটি করা হয় ২০১২ সালে।
কানাডা সম্প্রতি তাদের জাতীয় সঙ্গীতকে আরও লিঙ্গ নিরপেক্ষ করেছে। সঙ্গীতের দ্বিতীয় লাইনে ‘তোমার সব ছেলেরা’-এর জায়গায় লেখা হয়েছে ‘আমরা সবাই’।
প্রত্যেক দেশের জাতীয় সঙ্গীত তাদের নিজস্ব স্বকীয়তায় ইউনিক হলেও দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় সঙ্গীত এবং এর ইতিহাস দারুণ রোমাঞ্চকর। ১৯৯৪ সালে বর্ণবৈষম্যের অবসানের আগে, দক্ষিণ আফ্রিকায় দ্বৈত জাতীয় সঙ্গীত বা দুটো সঙ্গীত ছিল।
‘উঁচু’ শ্বেতাঙ্গের জন্য একটি আর ‘নিচু’ কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য আরেকটি। সরকারি রাষ্ট্রীয় গানটি ছিল “ডাই স্টেম”, যা ইংরেজিতে “দ্য কল অব সাউথ আফ্রিকা” নামে পরিচিত, তবে দেশটির “আই আফ্রিকা” বা “গড ব্লেস আফ্রিকা” নামে একটি অনানুষ্ঠানিক জাতীয় সঙ্গীতও ছিল; কালোদের এই গান, তারা বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের গান হিসাবে গাইতো।
প্রতিদ্বন্দ্বী এই দুই গান ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার অস্থির ইতিহাসের একটি সাক্ষাৎ প্রতীক হিসাবে দাঁড়িয়ে ছিল। তখন নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি নেলসন ম্যান্ডেলা ঘোষণা করেছিলেন যে “ডাই স্টেম” এবং “গড ব্লেস আফ্রিকা” জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে সম্মান ভাগ করে নেবে।
অবশেষে, ১৯৯৭সালে, দেশটি আগের দুটি জাতীয় সঙ্গীত থেকে কিছু অংশ নিয়ে নতুন একটি জাতীয় সঙ্গীত তৈরি করে। একটি অস্বাভাবিক মোড়ের মধ্যে, নতুন সঙ্গীতটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বাধিক কথ্য পাঁচটি ভাষার গানও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে: জোসা, জুলু, সেসোথো, আফ্রিকান এবং ইংরেজি।
আমাদের জাতীয় সঙ্গীত আমার সোনার বাংলা কে পরিবর্তনের চেষ্টা কিন্তু নতুন নয়। আগেও বিভিন্ন সরকারের আমলে বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে।
জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের পক্ষের একটি যুক্তি হলো, ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে রচিত হয়েছিল। আসলে, গানটির মূল পাণ্ডুলিপি পাওয়া না যাওয়ায় এর সঠিক রচনাকাল জানা যায় না। তবে, সত্যেন রায়ের লেখা থেকে জানা যায়, ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট কলকাতা টাউন হলে একটি প্রতিবাদসভায় এই গান প্রথম গাওয়া হয়। সেই বছর ৭ সেপ্টেম্বর (২২ ভাদ্র, ১৩১২ বঙ্গাব্দ) ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বাক্ষরে গানটি ছাপা হয়। গানের প্রথম দশ লাইনকে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত করা হয়েছে, তবে পুরো গান থেকে এবিষয়ে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় যে, ব্রিটিশ বিরোধী এবং স্বদেশি আন্দোলনের স্বপক্ষের গান এটি।
আরেকটি হাস্যকর বিষয় অনেকে তোলেন যে, রবীন্দ্রনাথ এই গানের সুর গগন হরকরার বাউল গান ‘আমি কোথায় পাবো তারে’ থেকে চুরি করেছেন। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন রচনা থেকে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় যে তিনি গগন হরকরা, লালন সহ বাউল গান এবং তাদের ভাটিয়ালী সুরে মুগ্ধ ও অনুপ্রাণিত হয়েছেন। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের জাতীয় সঙ্গীতের সুরে প্রকাশ্য মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
আমেরিকার জাতীয় সঙ্গীতের সুর নেওয়া হয়েছে একটি ইংরেজ পানশালার পপুলার গানের সুর থেকে। এমনকি ব্রিটিশ জাতীয় সঙ্গীত God save the king এর সুর সবচেয়ে বেশি কপি করা জাতীয় সংগীত।
তাই, গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাবো তারে’ গানের সুরে আমার সোনার বাংলা গাইতে আর আপত্তি থাকার কথা না। বরং, বাউল সুরের এই জাতীয় সংগীত আমাদের শান্তিকামী, ভাবুক জাতিসত্ত্বার প্রামান্য চিত্র হয়ে ওঠে যেনো।
আরও বলা হয়, আমার সোনার বাংলা গানে বাংলাদেশ শব্দটি কোথাও ব্যবহার করা হয়নি। তাই এই গান বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করে না।
বাংলাদেশ শব্দটাকে ব্যবচ্ছেদ করলে আমরা দেখি, যে দেশের নাম বাংলা কিংবা বাংলা ভাষাভাষীর দেশ। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ও বাংলায় কথা বলে। তবে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের জাতীয়তা বাংলাদেশি নয়, বরং ভারতীয়। আর ভারতীয়দের অফিসিয়াল ভাষা হিন্দি ও ইংরেজি। ওরা জাতীয় সঙ্গীত গায় হিন্দিতে – ‘জন গণ মন অধিনায়ক জয় হে’। উপরন্তু, ভারতের জাতীয় সঙ্গীতে পশ্চিমবঙ্গকে ‘বঙ্গ’ বলা হয়েছে, ‘বাংলা’ নয়। তাই ‘আমার সোনার বাংলা’ গানে যে বাংলার কথা বলা হয়েছে তার নির্যাস আজকের বাংলাদেশ ভীষণভাবে ধারণ করে।
আরেকটি প্রশ্ন ওঠে আমাদের জাতীয় সঙ্গীতে মা শব্দটি নিয়ে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সাথে জড়িত বা সমর্থকদের এক কঠিন চিন্তা আমার সোনার বাংলা গানের এই মা কে? এই পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথের ধর্ম পরিচয়কে টেনে নিয়ে এসে সন্দেহ করা হয় এই মা কি তবে সনাতনীদের দেবী মা কিনা।
এই প্রশ্নের উত্তর জাতীয় সঙ্গীতেই আছে। “ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে”, কিংবা “মা তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মত” – এই মা দেশ, মাতৃভূমি। পূজনীয় বা উপাস্য দেবতার আসনে আসীন দূরের বা ভয়ের কেউ নয় বরং একান্তই আপন, আমাদের সবচেয়ে ভালোবাসার মা রূপক দেশ।
জার্মানি, ফ্রান্স সহ অনেক দেশের জাতীয় সঙ্গীতে দেশকে পিতৃভূমি বা ফাদারল্যান্ড বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই জাতীয় সঙ্গীতগুলোতে ন্যাশনাল গ্লোরি বা জাতিগত গর্বের কথা বলা হয়েছে। অথচ আমাদের জাতীয় সংগীতে আমরা মাতৃভূমির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা বলি, বিভিন্ন ঋতুর কথা বলি, বলি দেশের জন্য আমাদের ভালোবাসার কথা। এ গানে কোনও উগ্র জাতীয়তা বোধ নেই, নেই কোন লিঙ্গ অসাম্যতা।
যে জাতীয় সঙ্গীতে দেশকে মা সম্বোধন করা হয়, তুমি সম্বোধন থেকে আবেগে এক নিমেষে সেই দেশ মাতৃকাকে তুই বলা যায়; কোনও শঙ্কা, লজ্জা বা দ্বিধা ছাড়াই গলা ছেড়ে গাওয়া যায়, দেশকে বলা যায় -আমি তোমায় ভালোবাসি!
যে গানে বটের ছায়া আছে, আমের মৌ মৌ গন্ধ আছে, মায়ের আঁচল আছে, সোনার ধানের ছোঁয়া আছে; যে গানে আকাশে বাতাসে বাউলের হৃদয় থেকে উঠে আসা করুণ সুর শুনি দেশ-মায়ের মলিন বদন দেখে ;
যে গানের সাথে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মুক্তিকামী যোদ্ধাদের একাত্মতা আছে, আছে স্বৈরাচার বিরোধী সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতা অভ্যুথ্থানের সম্পৃক্ততা; এই জাতীয় সঙ্গীতকে আত্মায় ধারণ করা কেবল আমাদের মতো দৃঢ়চিত্তের আর কোমল হৃদয়ের জাতির পক্ষেই সম্ভব।
লেখক: ফারজানা হুসাইন, ব্যারিস্টার-এট-ল,আইনজীবি এবং মানবাধিকার কর্মী