গত সপ্তাহে তুরস্ক এবং সিরিয়ায় ভূমিকম্পে এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের নিমিষেই মৃত্যু পুরো পৃথিবীর মানুষকে শোকাহত এবং হতবাক করেছে। ভূমিকম্পে বিধ্বংস্ত এলাকাগুলো থেকে এখনো লাশের সন্ধান মিলছে তার সঙ্গে সঙ্গে স্বজন হারানোর কান্নায় ভারি হয়ে উঠছে তুরস্ক-সিরিয়ার আকাশ বাতাস। এখনো তুরস্কের ভেঙে পড়া দালানগুলোর নিচ থেকে মৃত মানুষদের উদ্ধার করা হচ্ছে। গত ৬ ফেব্রুয়ারি তুরস্কের স্থানীয় সময় ভোর ৫টার দিকে তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে সিরিয়া সীমান্তের কাছে রিখটার স্কেলে ৭.৫ মাত্রার একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে। সে সময় উক্ত অঞ্চলের অনেক মানুষই ঘুমিয়েছিল যার কারণে তারা নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারেনি, ফলে তাদের বেশির ভাগই দালান চাপা পড়ে মৃত্যুবরণ করেছে। ভূমিকম্পের ধ্বংসলীলা এতবেলা মারাত্মক ছিল যে, হাজার হাজার পাকা দালান নিমিষেই ভেঙে পড়েছিল। তুরস্কের দক্ষিণ অঞ্চলের ভূমিকম্পের এতবেশি ধ্বংসযজ্ঞের প্রধান কারণ হচ্ছে এই ভূমিকম্পটি পুনঃপুন হচ্ছিল আর প্রভাবে ওই এলাকার প্রায় সব দালানই ভেঙে পড়েছিল। আর সেই ভেঙে পড়া দালানের নিচেই চাপা পড়ে প্রাণ দিয়েছিল ব্যাপক সংখ্যক মানুষ।
তুর্কি সংবাদ মাধ্যম কিছু ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করেছে তাতে বেশ বড় বড় পাকা দালান খুব সহজেই ভেঙে পড়তে দেখেছি আমরা। ভূমিকম্পের ধ্বংসস্তূপ থেকে বেশকিছু ছোট শিশুদের বের করা হয় যাদের মধ্যে বেশকিছু শিশু জীবিত ছিল। ভূমিকম্প পুরোপুরি থেমে যাওয়ার পর তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে স্বজনদের সন্ধান করতে দেখা গেছে আবার কেউ কেউ স্বজনের লাশ আঁকড়ে ধরে কাঁদতে দেখা গেছে। তুরস্কের কিছু কিছু জায়গায় এমন দেখা গেছে সেখানে শুধুই লাশের সারি আর স্বজনদের আহাজারি। তুর্কি হিসাব মতে ২৬৩ জন শিশুকে ধ্বংসস্তূপ থেকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে যাদের মা-বাবা কেউ বেঁচে নেই। বর্তমানে তুরস্কে প্রায় ৫৮টি দেশ উদ্ধার কার্য চালিয়ে যাচ্ছে। এসব ধ্বংসস্তূপের নিচে প্রাণের স্পন্দন খুঁজে বেড়াচ্ছে নির্ঘুম রাত কাটিয়ে।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিসে একটি প্রশিক্ষিত দল তুরস্কে উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি টিমও ওষুধসহ বিভিন্ন সামগ্রী নিয়ে তুরস্কে পৌঁছেছে। অন্যদিকে সিরিয়া অঞ্চলে প্রথমদিকে উন্নত দেশগুলের অবরোধের কারণে ত্রাণ নেয়া সম্ভব না হলেও বর্তমানে অবরোধ শিথিল করা উক্ত অঞ্চলে ত্রাণ পৌঁছতে শুরু করেছে। আশা করা যাচ্ছে সিরিয়া অঞ্চলের প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে খুব শিগগিরই জানা যাবে। প্রকৃতপক্ষে সিরিয়ায় বছরের পর বছর গৃহযুদ্ধের কারণে দেশটি এমনিতেই খুব খারাপ অবস্থায় আছে তার মধ্যে এই বিধ্বংসী ভূমিকম্প অনেক মানুষকেই উদ্বাস্তু রূপান্তর করবে, ফলে বিশ্বে অভিবাসীদের সংখ্যা বাড়বে। প্রকৃতপক্ষে ভূমিকম্প হচ্ছে একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, এমন দুর্যোগ সময়ে সময়ে পৃথিবীর অঞ্চলে ঘটে তবে এটা যখন অতিমাত্রায় আঘাত হানে তখন প্রাণহানির সংখ্যা বাড়ে এবং স্বজন হারানোর আহাজারিও বাড়ে। ভূমিকম্পের পূর্বাভাস আবিষ্কৃত না হওয়ায় যুগ যুগ ধরে মানুষ এর ধ্বংসযজ্ঞ দেখে আসছে।
ইদানীং ভূমিকম্পের পশুপাখির আচরণ দেখে বিশেযজ্ঞরা ভূমিকম্প হওয়ার বিষয়ে কিছুটা আঁচ করতে পারলেও তা যথাযথ বৈজ্ঞানিক যুক্তির অভাবে মানুষকে সতর্ক করা সম্ভব হয় না। অনেকেই আবার এমন পূর্বাভাসকে তেমন পাত্তাও দেয় না, ফলে প্রাণহানি বাড়ে। তুরস্কের ওই অঞ্চলটিতে অতীতে আরো কয়েকবার এমন ভূমিকম্পে ব্যাপক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল। বিভিন্ন প্রতিবেদন এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন তুরস্কের উক্ত অঞ্চলে পাকা দালান বানানোর সময় বিল্ডিং কোড মানা হয় না ফলে বিল্ডিংগুলো ভূমিকম্প সহনীয় না হওয়ায় এগুলো তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ছে, ফলে প্রাণহানি ব্যাপক হারে বেড়েছে। বর্তমানে তুরস্ক এবং সিরিয়ার ভূমিকম্প উপদ্রুত এলাকায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৪ হাজারেরও বেশি। এখনো ধসেপড়া দালানগুলোর নিচে লাশ পাওয়ার আশঙ্কা করছে বিভিন্ন দেশের উদ্ধারকারী দল। এত ব্যাপক মৃত্যু যদি শুধু বিল্ডিং কোড না মানার কারণে হয়, তাহলে ভবিষ্যতে তুরস্ক সরকারকে এ বিষয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
রতন কুমার তুরী : শিক্ষক ও লেখক, ঢাকা।
rk.turi1952@gmail.com