মুক্তভাষ ডেস্ক
বাংলা সাহিত্য নিয়ে মহামতি বঙ্কিমচন্দ্র বেশ উন্নাসিকতার সাথে মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বাংলা সাহিত্যকে কাঁচাকলার সাথে তুলনা করেছিলেন এবং যারা বাংলা সাহিত্যের বিকি-কিনি করেন বা রচনা করেন তাদেরকে বালক হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। এসব মন্তব্য সবার জানা। তবে কবি যশঃপ্রার্থীরা এসব মন্তব্যে হতোদ্যম হয়েছেন বলে মনে হয় না। বরং কবিদের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে কবি হয়েও কবিদের সম্পর্কে বিশেষ করে বাঙালি কবিদের নিয়ে যা বলেছেন তা আমাদের কবিরা জানেন কিনা আমাদের জানার সুযোগ নেই তবে অনুমান করা চলে যে এখনকার অধিকাংশ কবিরা তাঁর এ জাতীয় লেখা বা মন্তব্য পড়েননি। পড়লে অন্তত আমাদের দশায় পরিবর্তন হতো। তিনি ভাদ্র ১২৮৭ সালে ভারতী পত্রিকায় এবং আষাঢ় মাসে ভারতী পত্রিকায় দুটি প্রবন্ধ লেখেন। শিরোনাম শুনলেই বাঙালি কবিদের একটু অভিমান হতে পারে। তাঁর প্রবন্ধ দুটির নাম ‘বাঙালি কবি নয়’ এবং ‘বাঙালি কেন কবি নয়’। অর্থাৎ বাঙালি কবি নয় সে দাবী তিনি করেছেন এবং সেই দাবীর পক্ষে প্রমাণ হাজির করার চেষ্টা করেছেন অন্য প্রবন্ধে। কিছু কবিকে আশ্বস্ত করা যায় এই বলে যে বাঙালির মধ্যে কেউ কেউ ব্যতিক্রমীভাবে কবি হতে পারেন। তবে আরও পরে মোক্ষম একটা কথা বলেছিলেন আরেক বিখ্যাত বাঙালি কবি জীবনানন্দ দাশ। তিনি বলেছিলেন প্রবাদের মতো সেই কথা- ‘সকলেই কবি নন। কেউ কেউ কবি; কবি…কেননা তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা রয়েছে এবং তাদের পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধরে এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্য বিকিরণ তাদের সাহায্য করছে।’ রবীন্দ্রনাথের জন্ম দিবসে এ সব ঋণাত্মক কথাবার্তা বলার হয়তো ঘোর কোনো যুক্তি নেই তবু এ দিবসে একজন কবি হিসেবে তিনি বাঙালি কবির কী কী বৈশিষ্ট্য সনাক্ত করতে পেরেছিলেন তার সমান্য ফিরিস্তি বর্তমান কবিদের সামনে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন অনুভব করছি।
রবীন্দ্রনাথ বাংলাভাষার প্রধানতম কবি হতে পেরেছিলেন একই সঙ্গে নিজের অক্ষমতাকে, বাঙালির সার্বিক দুর্বলতাকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছিলেন। আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমরা তাঁর কথাকে আমলে নেইনি। তাঁকে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছি, তাঁকে পুজো করেছি তবে তাঁকে অনুসরণ করিনি। বাংলা ভাষার নতুন কবিরা তাঁকে অনুসরণ করবেন আশা করতে পারি।
রবীন্দনাথের সময়েও অজস্র কবি ছিলেন, হয়তো এখনকার মতো নয়। এখন যেমন কবি তকমা পাওয়ার জন্য নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে অজস্র বই লেখা হচ্ছে তখন এতটা করার সুযোগ না থাকলেও অনেক অকবি যে ছিলেন সেটা কবিগুরুর রচনায় উল্লেখ পাওয়া যায়। বাঙালির যেহেতু দার্শনিক বা বৈজ্ঞানিক হবার সুযোগ কম তাই সে কবি হওয়াকে সহজ পথ মনে করেছে। কিন্তু কবি হতে যে বিস্তর জ্ঞান ও লেখাপড়া লাগে সে বিষয়ে বিস্মৃত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তাদেরকে ভণ্ড ময়ূরের সাথে তুলনা করেছেন। তারা কিছু স্তাবক রাখে যারা তাদেরকে ময়ূর বলে ঢোল পেটায়, বাস্তবে তারা কাক। তাদের ধারণা বাংলা কবিদের জন্য উর্বর ভূমি। তাই তারা প্রাণন্তকর চেষ্টা করে কবি হবার জন্য, যশঃপ্রার্থী হবার জন্য। কবি তাদের উদ্দেশ্যে শ্লেষমিশ্রিত সুরে বলেছেন, ‘আজকাল শত শত বালক আধপয়সা মূলধন লইয়া (বিদেশী মহাজনদিগের নিকট হইতে ধার করা) দিন রাত প্রাণপূর্বক বাংলা সাহিত্য-ক্ষেত্রে কবিত্ব চাষ করিতেছেন; আজ যখন দেখিলেন বাংলা সাহিত্য-ক্ষেত্রে তাঁহাদের যত্নে কাটা-গাছ ও গুল্মে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে তখন তাহারা কপালের ঘাম মুছিয়া হর্ষ-বিস্ফারিত নেত্রে দশজন প্রতিবেশীকে ডাকিয়া কহিতেছেন, আহা! জমি কী উর্বরা।’ অন্যত্র বলেছেন, ‘দেখিতেছ না, আজকাল বাংলার সকলেই কবিতা লেখে। সকলেই মিত্রাক্ষর ও অমিত্রাক্ষর ছন্দে বাংলা বর্ণমালা কাগজে গাঁথিতেছে, তাহা দেখিয়াই যদি বাঙালি জাতিকে বিশেষ রূপে কবি জাতি আখ্যা দাও, হে চাষা, ক্ষেত্রে অগণ্য কাঁটা গাছ দেখিয়া ফসল ভ্রমে যদি তোমার মনে বড়ো আনন্দ হইয়া থাকে, তবে তোমার মঙ্গলের জন্যই তোমার ভ্রম ভাঙা আবশ্যক।’
কবি বাঙালি কবিদের প্রতি বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য করেছেন সেটা যেমন ঠিক তেমনি এটাও ঠিক যে তাঁর কথা যুক্তিহীন নয়। সার্বিকভাবে বাঙালির যে চরিত্র সেখানে গভীর অর্থে কবি হয়ে ওঠা তার পক্ষে সব সময় সম্ভব নয় বলে কবি মনে করেন। কারণ বাঙালির আবেগ আছে সত্য তবে আবেগের গভীরতা নেই এবং সেই আবেগকে গভীর অর্থে ব্যবহার করার ক্ষমতা বাঙালির নেই বা চেষ্টা নেই। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের জাতীয় চরিত্রে উত্তেজনা নেই, উত্তেজনা নাই বলিতে বুঝায়, আমরা কিছুতেই তেমন গভীর রূপে, তেমন চূড়ান্ত রূপে অনুভব করতে পারি না। ঘটনা ঘটে, আমাদের হৃদয়ের পদ্মপত্রের উপর পড়িয়া তাহা মুহূর্তকাল টলমল করে, আবার পিছলাইয়া পড়িয়া যায়।’
এ কথার তাৎপর্য অত্যন্ত ব্যাপক। যে ব্যক্তি কবি হবেন, গড় বাঙালিদের ধারণা সে জন্ম থেকেই স্বভাবগতভাবে কবি। এবং তিনি অনেকটা ওহি প্রাপ্তির মতো বাণী পান আর গড় গড় করে লিখে চলেন বাল্মীকীর মতো। এই তরতর করে লেখার অর্থ তিনি ভাবেন কম। তার চিন্তার বিস্তার ও পরিধি কম। যা তিনি লিখছেন তার তাৎপর্য কী তা তিনি ভাবতে পারেন না বা ভাবেন না। শুধু আবেগ বা জোয়ারে ভেসে আসা কিছু তাড়নাজাত অভিপ্সাকে কবিতা মনে করা ভুল। কল্পনার ও সীমা থাকে, তার শক্তি থাকে। আমাদের একজন বিখ্যাত কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বলেছিলেন, আবেগী কবিকে আমার ভয় হয়। অথাৎ আবেগের ঘাড়ে চড়ে তিনি অনর্থ করতে পারেন যা শিল্পের জন্য শোভন নয়, সুন্দর নয়, ক্ষতিকর। বাঙালির জীবন অলস জীবন, এটা তার স্বভাবগত। কোনো আয়াস ছাড়া সে সহজে যা পায় তাই নিয়ে তৃপ্ত হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে একজন অলস মানুষ কীভাবে ভালো কবি হবেন? কারণ যে তার নিজের বৈচিত্র্যহীন জীবনের অলস জীবনযাত্রার কিছু কালিঝুলি নিয়ে কবিতা লিখতে চান তিনি চারণ কবির মতো কিছু সাময়িক উত্তেজিত পদ রচনা করতে পারেন সত্যিকার অর্থে কবিতা লিখতে পারবেন না।
অনেকে মনে করেন, মানুষ দু ধরনের- কাজের মানুষ ও কল্পনাপ্রধান মানুষ। এবং এরা দুই জগতের বাসিন্দা। একজন উত্তরমেরুর, অন্যজন দক্ষিণমেরুর। বাস্তবতা হলো কাজের লোকেরও কল্পনাশক্তির প্রয়োজন। কবিকে একই সঙ্গে শক্তিশালী মনোবৃত্তি সম্পন্ন হতে হবে। বুদ্ধি, কল্পনা ও অভিজ্ঞতা এসবের মিশেলে শক্তিশালী ধী শক্তির অধিকারী হবেন কবি। বাঙালির মধ্যে এর অভাব আছে। কবি বলেছেন, ‘যাহার মনোবৃত্তি সকল অত্যন্ত দুর্বল, সে কখনো কবি হইতে পারিবে না। যে বিশেষরূপে অনুভব করতে পারেনা সে বিশেষরূপে প্রকাশ করিতে পারে না। বলাবাহুল্য যে, বাঙালির হৃদয়ে ভাবের অর্থাৎ অনুভাবকতার গভীরতা, বলবত্তা নাই। তাহা যদি থাকিত তবে কার্যেও এত দরিদ্রদশা কেন থাকিবে? অতএব বাঙালি জাতি যদি না ভাবে সে প্রকাশ করিবে কীরূপে? কবি হইবে কীরূপে?’
বাঙালি সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে গুটিকয় ক্ষেত্রে তবে রবীন্দ্রনাথ বোধ হয় খুব বেশি সাহসী ভূমিকায় বাঙালিকে দেখার সুযোগ পাননি। তিনি ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিকে বা বাঙালি কবিকে সাহসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখেননি। দেখলে হয়তো তিনি একটু খুশি হতে পারতেন। তিনি ইংরেজের সাহস, অনুসন্ধিৎসা ও কাজের প্রেরণা দেখে আন্দোলিত হয়েছিলেন। আর সেকারণেই যে ইংরেজ কবিরা উৎকৃষ্ট বা মহৎ কবিতা লিখে সত্যিকার কবি হয়েছেন সেটা তিনি বিশ্বাস করতেন। সত্য কথা আমাদের জীবনে কর্মের যোগ নেই, কর্মের প্রেরণাশক্তিতে মানুষের মধ্যে যে শক্তি জন্মে সে শক্তি হলো স্থায়ী শক্তি। বাঙালির মধ্যে তার অভাব রয়েছে। বাঙালি ঘরের কোণে বসে ভাবুক হয়েছে, কখনো বৈরাগ্য সাধনা করেছে, কঠিন কর্ম সাধনার বিপরীতে কর্মবিমুখ সাধনার পথে হেঁটেছে। সে দেশে দেশে ঘুরে জীবনের বিচিত্র জীবনধারা পর্যবেক্ষণে উৎসাহী হয়নি, ঘরে বসে বসে ধ্যান করেছে, নতুন নতুন ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছে তবে পরিবর্তনকামী উদ্দীপক সংগ্রামী কিছু করতে পারেনি। কাজেই অভিজ্ঞতাহীন কিছু আপ্তবাক্য তার সঞ্চয়ে জমা হয়েছে, বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ সত্যিকার কবিতা তার ঝুলিতে স্থান করে নিতে পারেনি। ফলে আমরা খুব বেশি উন্মুক্ত হতে পারিনি, উদার হতে পারিনি, জীবনের সব অর্গল খুলে দিতে পারিনি।
জীবনের বিচিত্র রসবোধের সাথে অনেকক্ষেত্রে আমাদের পরিচয় নেই। গৃহী হিসেবে আমাদের সুনাম আছে সত্য। আবার সিদ্ধার্থের মতো বেরিয়ে পড়ার গৌরবও আমাদের রয়েছে। তবে কবিতা সৃষ্টির জন্য কর্মানন্দ, বুদ্ধির প্রগাঢ়তার খামতি আমাদের থেকেই গেছে। আমাদের সার্বিক মনোবৃত্তিগুলো সব সময় প্রস্ফুটিত হয়নি। আমরা সেগুলো চাপা দিয়ে গেছি বরাবর। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘আমাদের ভালোবাসা কখনো সদর দরোজা দিয়ে ঢোকে না; খিড়কির সংকীর্ণ ও নত দরোজা দিয়ে আনাগোনা করিয়া করিয়া তাহার পিঠ কুঁজা হইয়া গিয়াছে, সে আর সোজা হইয়া চলিতে পারে না, কারো মুখের পানে স্পষ্ট অসংকোচে চাহিতে পারে না, নিজের পায়ের শব্দ শুনিলে চমকিয়া উঠে। এমনতর সংকুচিত কুব্জ ভালোবাসার হৃদয় কখনো তেমন প্রশস্থ হইতে পারে না। মনে করো ‘পিরিতি’ কথার অর্থ বস্তুত ভালো, কিন্তু বাঙালির হাতে পড়িয়া দুই দিনে এমন মাটি হইয়া গিয়াছে আজ শিক্ষিত ব্যক্তিরা ও কথা মুখে আনতে লজ্জা বোধ করেন।’
আজকের বাঙালিরা যে হারে কবি হয়ে ওঠার জন্য প্রাণপণ লড়াইতে নেমেছেন, যে হারে নতুন নতুন কবিতার পুস্তক ছাপা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ জীবিত থাকলে কী মন্তব্য করতেন তা আমরা অনুমান করতে পারি না। রবীন্দ্রনাথ নিজেও কবি ছিলেন, চাইতেন তাঁর কবিতা সবাই পড়ুন, শতবর্ষ পরেও সবাই পড়ুন, তবে সেটা সত্যিকার অর্থে কবিতা। যেখানে কবিতা তার সব মহিমা নিয়ে হাজির হয় সামান্য আবেগের বুদবুদ আর দুএকটা চটকদার পঙক্তির বেসাতি নিয়ে নয়। যারা আজ কবি হবার দুর্ময় বাসনা পোষণ করেন, তাদের জন্য কবিগুরুর আরো কয়েকটি পঙক্তি পেশ করে এই ছোট্ট লেখা শেষ করছি: আধুনিক বাঙালি কবিতা লইয়া বিস্তারিত আলোচনা করা বড়ো সহজ ব্যাপার নহে। সাধারণ কথায় বলিতে হইলে বলা যায়, কবির সংখ্যা যথেষ্ট বৃদ্ধি পাইয়াছে; সজনি, প্রিয়তমা, প্রণয়, বিরহ, মিলন লইয়া অনেক কবিতা রচিত হইয়া থাকে, তাহাতে নতুন খুব কম থাকে এবং গাঢ়তা আরো অল্প। আধুনিক বঙ্গ কবিতায় মনুষ্যের নানাবিধ ক্রীড়া দেখা যায় না। বিরোধী মনোবৃত্তির সংগ্রাম দেখা যায় না। মহান ভাব তো নাই-ই। হৃদয়ের কতকগুলো ভাসা ভাসা ভাব লইয়া কবিতা। সামান্য নাড়া পাইলেই যে জল-বুদবুদগুলি হৃদয়ের উপরিভাগে ভাসিয়া উঠে তাহা লইয়া তাঁহাদের কারবার।…তথাপি কী করিয়া বলি বাঙালি কবি?
লেখক: মোস্তফা তারিকুল আহসান