আজ অবধি আমরা সবাই কমবেশি জানি যে সরকারি চাকরির কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য ছাত্ররা যে আন্দোলন শুরু করেছিল জুন মাস থেকে তার পরিসমাপ্তি ঘটে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ এবং দেশত্যাগের মাধ্যমে আগস্ট মাসে। সরকারি চাকরির কোটা ব্যবস্থা অনেক বছর ধরে বিতর্কিত ছিল, কারণ এটিতে মেধা এবং কোটার মধ্যে বিস্তর বৈষম্য ছিল, যা অনেক মেধাবী ছাত্রের জন্য হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই বঞ্চনার বিরুদ্ধে ক্ষোভ ধীরে ধীরে একটি আন্দোলনে রূপ নেয়। এই উল্লেখযোগ্য ছাত্র আন্দোলনটি মূলত শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালে ঘোষিত কোটা পদ্ধতি বিলুপ্তি করার পরেও এটাকে আবার ২০২৪ সালের ৩১ মে কোটার পুনঃপ্রবর্তন সংক্রান্ত আদেশ প্রদান করার ফলে। এই আন্দোলনকে দমানোর জন্য সরকারি ফোর্সের পাশাপাশি সরকার তার নিজের দলের লোকদের ব্যবহার করে। যার ফলে সরকারি ফোর্স এবং অন্যদের গুলিতে এই আন্দোলনে শত শত ছাত্র জনতা মারা যায়। ফলে এই গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনটি ধীরে ধীরে একটি এক দফা দাবিতে পরিণত হয়, যার মূল দাবি হয়ে ওঠে সরকারের পদত্যাগ।
অবশেষে ছাত্র জনতা সফল হয় এবং সরকার প্রধান দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যান। এই আন্দোলনটি প্রধানত তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছিল, যা বাংলাদেশের অনেক মানুষের জন্য বিস্ময়ের কারণ বলেও প্রতীয়মান হয়।
প্রশ্ন জাগে তরুণ প্রজন্মের সাফল্য এবং নেতৃত্বের পিছনে কী কী কারণ সাহস জুগিয়েছিল? এই লেখায় এই প্রশ্নের উত্তরকে একটি সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এখানে আমি পিয়েরে বুর্ডিয়ুর (Pierre Bourdieu) “সাংস্কৃতিক মূলধন” (Cultural Capital) তত্ত্ব এবং জেন পিয়াজে’র (Jean Piaget) “শিশু উন্নয়ন” (child development) তত্ত্ব ব্যবহার করে এই তরুণ নেতৃত্বের কারণ ও প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি।
পিয়েরে বুর্ডিয়ু, একজন প্রখ্যাত ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী। তার “সাংস্কৃতিক মূলধন” তত্ত্বের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন স্তরে কীভাবে সামাজিক শক্তি, শিক্ষা এবং সামাজিক প্রভাব কাজ করে তার ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। বুর্ডিয়ুর মতে, সাংস্কৃতিক মূলধন তিন ধরনের হতে পারে: অবস্থা মূলধন (embodied), বস্তুগত মূলধন (objectified) এবং প্রাতিষ্ঠানিক মূলধন (institutionalized)।
অবস্থাগত মূলধন (Embodied Capital): এই মূলধন ব্যক্তির জ্ঞান, দক্ষতা এবং অভ্যাসের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ছাত্র আন্দোলনের ক্ষেত্রে, তরুণ প্রজন্মের নেতারা তাদের অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতা ব্যবহার করে কৌশলগতভাবে আন্দোলন পরিচালনা করেছেন। তাদের শিক্ষাগত পটভূমি এবং সমালোচনামূলক চিন্তা করার ক্ষমতা ও দক্ষতা তাদের কার্যকর নেতৃত্ব দিতে সাহায্য করেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আন্দোলনের নেতা ও কর্মীরা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে তাদের বার্তা ছড়িয়েছেন এবং বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে তাদের যথাযথ যুক্তি তুলে ধরেছেন।
বস্তুগত মূলধন (Objectified Capital): এই মূলধন সাংস্কৃতিক সামগ্রী, যেমন- বই, যন্ত্রপাতি ইত্যাদির মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। আন্দোলনের সময়, তরুণ প্রজন্ম সামাজিক মিডিয়া, প্রযুক্তি এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক মাধ্যম ব্যবহার করে তাদের দাবির প্রচার করেছেন। এটি তাদের আন্দোলনের প্রচারণা বাড়াতে সাহায্য করেছে। উদাহরণস্বরূপ, তারা আন্দোলনের ভিডিও, ছবি এবং পোস্টার তৈরি করে এবং তা সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করে দ্রুত জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
প্রাতিষ্ঠানিক মূলধন (Institutionalized Capital): এই মূলধন আনুষ্ঠানিক শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং তাদের পরবর্তী কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ছাত্রনেতারা তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে সমাজে সম্মান অর্জন করেছেন, যা তাদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে অনুপ্রাণিত করেছে। উদাহরণস্বরূপ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাদের শিক্ষাগত পরিচয় বা ছাত্র পরিচয় সবসময় ব্যবহার করে আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি জোরদার করেছেন।
পিয়াজে’র শিশু উন্নয়ন তত্ত্ব: জ্যঁ পিয়াজে (Jean Piaget) একজন সুইস মনোবিজ্ঞানী, তিনি শিশুদের মানসিক বিকাশের পর্যায়গুলো ব্যাখ্যা করেছেন। পিয়াজে’র মতে, শিশুরা চারটি প্রধান পর্যায়ে মানসিক বিকাশ লাভ করে:
সংবেদী-মোটর পর্যায় (Sensorimotor stage) (জন্ম-২ বছর): এই পর্যায়ে শিশুরা সংবেদী অভিজ্ঞতা এবং মোটর দক্ষতার মাধ্যমে বিশ্বকে বুঝতে শেখে।
প্রাক-সংস্থাপনা পর্যায় (Preoperational stage) (২-৭ বছর): এই পর্যায়ে শিশুরা ভাষা এবং প্রতীক ব্যবহার করে চিন্তা করতে শেখে।
কংক্রিট সংস্থান পর্যায় (Concrete operational stage) (৭-১১ বছর): এই পর্যায়ে শিশুরা যৌক্তিকভাবে চিন্তা করতে এবং সমস্যার সমাধান করতে শেখে।
আবস্ট্রাক্ট সংস্থান পর্যায় (Formal operational stage) (১১-বয়স্ক): এই পর্যায়ে শিশুরা বিমূর্তভাবে চিন্তা করতে এবং তত্ত্বীয়ভাবে বিশ্লেষণ করতে শেখে।
বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনে তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বের প্রেক্ষাপটে পিয়াজে’র তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা স্পষ্ট। তরুণরা এই আন্দোলনে আবস্ট্রাক্ট সংস্থান পর্যায়ে ছিল, যেখানে তারা বিমূর্তভাবে চিন্তা করতে এবং তত্ত্বীয়ভাবে বিশ্লেষণ করতে সক্ষম। তাদের চিন্তা-ভাবনা এবং কৌশলগত পরিকল্পনা এই পর্যায়ের বৈশিষ্ট্যগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। পূর্ববর্তী পর্যায়গুলোও এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে, কারণ এই ছাত্রছাত্রীরা ২০১৮ সালে আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল এবং সেখান থেকে তাদের মধ্যে নেতৃত্ব প্রদানের একটি মনোভাব সৃষ্টি হয়। তারা সামাজিক এবং রাজনৈতিক অসামঞ্জস্যতা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেছে এবং এটি পরিবর্তন করার জন্য একটি দৃঢ়প্রতিজ্ঞা নিয়ে এগিয়ে এসেছে। তাদের সমালোচনামূলক চিন্তা করার ক্ষমতা এবং যৌক্তিকভাবে সমস্যা সমাধান করার দক্ষতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে সাহায্য করেছে।
তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বের অনেক কারণ থাকতে পারে, আমি এখানে তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বের পিছনে কয়েকটি কারণ কাজ করেছে বলে আমি মনে করি।
শিক্ষাগত মূলধন: তরুণ প্রজন্ম উচ্চশিক্ষিত এবং সমালোচনামূলক চিন্তা করার ক্ষমতা রাখে। তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং অর্জিত জ্ঞান আন্দোলনে তাদের নেতৃত্ব দিতে সাহায্য করেছে।
সাংস্কৃতিক সচেতনতা: তরুণ প্রজন্ম সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এবং সমাজের অসামঞ্জস্যতা সম্পর্কে সচেতন। তারা সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম করতে প্রস্তুত।
প্রযুক্তিগত দক্ষতা: তরুণ প্রজন্ম সামাজিক মিডিয়া এবং প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ। তারা এই প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করে তাদের দাবি এবং আন্দোলনের প্রচার করতে সক্ষম হয়েছে।
বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্ব ব্যাখ্যা করার জন্য পিয়েরে বুর্ডিয়ুর “সাংস্কৃতিক মূলধন” তত্ত্ব এবং জ্যঁ পিয়াজে’র “শিশু উন্নয়ন” তত্ত্ব দুটি কার্যকর উপায় হতে পারে। তাদের শিক্ষাগত, সাংস্কৃতিক এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা তাদের সফল নেতৃত্ব দিতে সাহায্য করেছে। এই তত্ত্বগুলোর আলোকে, আমরা দেখতে পাই যে তরুণ প্রজন্ম কেবল বর্তমান নয়, ভবিষ্যতের নেতৃত্ব প্রদানে সক্ষম। তাদের উদ্যম, সাহস এবং ন্যায়বিচারের প্রতি অবিচল বিশ্বাস আমাদের সবার জন্য একটি অনুপ্রেরণা।
এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি, একটি নতুন, নিরপেক্ষ এবং সুন্দর সমাজ গড়ে তোলার জন্য আমাদের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে। এই পদক্ষেপগুলো সমাজের সব স্তরে সমতা, ন্যায়বিচার, এবং সদ্ভাব প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করবে।
১. শিক্ষার মানোন্নয়ন
শিক্ষার মাধ্যমে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি সুশৃঙ্খল, জ্ঞানসমৃদ্ধ এবং মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজে গড়ে তুলতে পারি। সব স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্মত শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বৈষম্যহীন শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে, যাতে ছাত্রছাত্রীরা সঠিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা এবং সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধের শিক্ষা পায়।
২. আইনের শাসন
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা একটি ন্যায়বিচারপূর্ণ সমাজের ভিত্তি। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে যেখানে সব নাগরিকের জন্য সমান অধিকার এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে। বিচার ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা এবং দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে, যাতে কোনও অপরাধী শাস্তি এড়াতে না পারে।
৩. রাজনৈতিক সংস্কার
রাজনীতি হলো একটি সমাজের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, তবে তা যদি সুষ্ঠু না হয় তাহলে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। দলীয় রাজনীতি থেকে তরুণ সমাজকে দূরে থাকতে হবে। দলীয় রাজনীতির প্রভাব কমাতে হবে এবং একটি নিরপেক্ষ রাজনীতি গড়ে তুলতে হবে। স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে, যাতে জনগণের প্রকৃত মতামত প্রতিফলিত হয়।
৪. সামাজিক সমতা
সামাজিক বৈষম্য দূর করতে হবে এবং সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে হবে এবং নারী-পুরুষ সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। ধনী-গরিবের মধ্যে পার্থক্য কমাতে এবং সবার জন্য অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করতে হবে।
৫. প্রযুক্তির ব্যবহার
প্রযুক্তির ব্যবহার করে একটি আধুনিক সমাজ গড়ে তোলা যায়, যেখানে তথ্য ও যোগাযোগের প্রবাহ সহজ হয়। ডিজিটালাইজেশন বাড়াতে হবে এবং ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। সাইবার অপরাধের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
৬. সামাজিক সম্প্রীতি
সমাজে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে হলে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। ধর্মীয় সহনশীলতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং ধর্মীয় গোঁড়ামি দূর করতে হবে। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে সম্মান করতে হবে এবং সব সংস্কৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে।
৭. যুব নেতৃত্ব
যুব নেতৃত্ব হলো সমাজের পরিবর্তনের মূল চালিকা শক্তি। যুবকদের জন্য বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মসূচি চালু করতে হবে, যাতে তারা সমাজের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে। যুবকদের জন্য নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করতে হবে, যাতে তারা ভবিষ্যতে সমাজের নেতৃত্ব দিতে পারে।
আমরা বলতে পারি বাংলাদেশের বর্তমান ছাত্র আন্দোলন একটি নতুন সমাজের সম্ভাবনা তৈরি করেছে, যেখানে বৈষম্য, দলীয় রাজনীতি, অপবাদ এবং ঘৃণা থাকবে না। শিক্ষা, আইনের শাসন, রাজনৈতিক সংস্কার, সামাজিক সমতা, প্রযুক্তির ব্যবহার, সামাজিক সম্প্রীতি এবং যুব নেতৃত্বের মাধ্যমে আমরা একটি সুন্দর এবং আধুনিক সমাজ গড়ে তুলতে পারি। এই সমাজ হবে একটি উদাহরণ যেখানে তরুণ প্রজন্ম নেতৃত্ব দেবে এবং সবাই সমান সুযোগ পাবে। একটি স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তোলার এই প্রচেষ্টা আমাদের সবার সম্মিলিত দায়িত্ব এবং প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ বাস্তবে পরিণত হবে।
লেখক: আব্দুল ওহাব শিক্ষক, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়; সমন্বয়ক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ।