বাংলা প্রবাদে আছে, ‘হাতি গর্তে পড়লে চামচিকাও লাথি মারে’। এই সংক্রান্ত ইংরেজি যে প্রবাদটি আছে তাহা হইল—লিটল বার্ডস মে পিক আ ডেড লাইওন। এখানে সিংহ ও ছোট পাখির কথা বলা হইলেও মর্মার্থ একই। তবে বাংলা প্রবাদটিকে অনেক সময় ঘুরাইয়া-ফিরাইয়া এইভাবেও বলা হয়—আমেরিকা গর্তে পড়িলে উগান্ডাও লাথি মারে। সাম্প্রতিক কালের ঘটনায় উগান্ডার জায়গায় কেহ কেহ আফগানিস্তানের নামও লইতে পারেন। আর অতি সম্প্রতি যাহা ঘটিতেছে তাহাতে সৌদি আরবের নাম যুক্ত হইতে পারে অবলীলায়। যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি সত্ত্বেও চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেই দৈনিক জ্বালানি তেলের উৎপাদন ২০ লক্ষ ব্যারেল কমাইবার ঘোষণা দিয়াছে সৌদি আরব নেতৃত্বাধীন ওপেক-প্লাস। ইহাতে ক্ষুব্ধ হইয়াছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসাবে দেশটির নিকট অস্ত্র বিক্রয় বন্ধসহ নিরাপত্তায় নিয়োজিত মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারেরও দাবি উঠিয়াছে। অবশ্য সৌদি আরব বলিতেছে, ইহা তাহাদের একক কোনো সিদ্ধান্ত নহে, ইহা তেল উত্পাদনকারী দেশসমূহের ফোরামের যৌথ সিদ্ধান্ত। তবে এই ফোরামে রাশিয়াসহ কয়েকটি দেশ অন্তর্ভুক্তির কারণে ওপেক হইয়াছে ওপেক-প্লাস। তাই আগামী নভেম্বর হইতে তেলের উৎপাদন হ্রাস করিবার ব্যাপারে তলে তলে রাশিয়া যে কলকাঠি নাড়িতেছে না, তাহার বা নিশ্চয়তা কোথায়?
বিদ্যমান বিশ্বপরিস্থিতি দেখিয়া যে কাহারো মনে প্রশ্ন উঠিতে পারে, পৃথিবীর আসলে কী হইয়াছে? সবখানে আতঙ্ক, ভয় এমনকি পরমাণু যুদ্ধেরও আশঙ্কা করা হইতেছে। অর্থনৈতিক মন্দায় দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা গেলেও বিশ্বনেতাদের কোনো রা নাই। তাহারা ব্যস্ত যুদ্ধবিগ্রহ লইয়া। ইহাতে বিশ্বব্যবস্থা ও শৃঙ্খলা আজ ভাঙিয়া পড়িয়াছে। কথায় কথায় যে যাহাকে পারিতেছে হুমকি দিতেছে। যুক্তরাষ্ট্রকে এখন অনেক দেশ পাত্তা দিতেছে না। এই যুদ্ধের মধ্যেও মার্কিন চাপ উপেক্ষা করিয়া রাশিয়ার নিকট হইতে তেল ক্রয় করিতেছে ভারত। চীন ইউয়ান-ইউরো দিয়া তেল কিনিতে চাহিতেছে। উত্তর কোরিয়া একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়িতেছে। ইরান হুমকি দিয়া বলিতেছে, তাহারা পারমাণবিক কর্মসূচি হইতে সরিয়া আসিবে না। মেক্সিকো বলিতেছে, তাহারা রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য চালাইয়া যাইবে। ভেনেজুয়েলা বলিতেছে, তাহারা আমেরিকাকে অতিরিক্ত তেল দিবে না। ইহাতে বুঝা যাইতেছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিছক কোনো যুদ্ধ নহে, বহু মেরুকরণের যুগে নয়া বিশ্বব্যবস্থা (নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার) প্রতিষ্ঠা করিবার এক প্রাণান্তকর প্রতিযোগিতা।
কিছুদিন আগে উজবেকিস্তানের সমরখন্দে অনুষ্ঠিত হইয়া গেল সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (এসসিও) বৈঠক। সেখানে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং স্পষ্ট করিয়া বলিয়াছেন যে, পশ্চিমা বিশ্বের প্রভাবের বাহিরে এশীয় নেতাদের বিশ্বব্যবস্থায় পরিবর্তন আনিতে হইবে। আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে দিতে হইবে নূতন আকার। নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও তাহার নেতৃত্বাধীন ওয়ারশ জোটের বিলুপ্তির পর তত্কালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ বুশ ‘নূতন বিশ্বব্যবস্থার তত্ত্ব’ হাজির করেন। ইহার মাধ্যমে আমেরিকার নেতৃত্বে একমেরুকরণ বিশ্বব্যবস্থার গোড়াপত্তন হয় এবং গণতন্ত্র, জাতীয়তা, আইনের শাসন, মানবাধিকার, বিশ্বায়ন, পারস্পরিক সহযোগিতা, জ্ঞানবিজ্ঞানের উন্নয়ন ইত্যাদি ধারণা প্রাধান্য পায়। কিন্তু এখন যে নূতন বিশ্বব্যবস্থার কথা বলা হইতেছে, তাহার ভিত্তি কী, তাহা আমাদের অজানা। যখন কোনো বিশ্বশক্তির উত্থান বা পতন হয়, তখনই দেশে দেশে অস্থিরতা তৈরি হয়। কিন্তু আমেরিকা, রাশিয়া ও চীন এই ত্রিশক্তির একক বিবেচনায় এখনো আমেরিকা সুবিধাজনক অবস্থানে রহিয়াছে। কিন্তু অসুবিধা হইল আমেরিকার আসন্ন মিডটার্ম নির্বাচন। এই নির্বাচনে সিনেট ও হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভস উভয় ক্ষেত্রে জো বাইডেনের ডেমোক্র্যাটরা আশানুরূপ ফল না করিলে পরবর্তী দুই বৎসর জো বাইডেন তেমন কিছুই করিতে পারিবেন না। ইহারই সুযোগ লইতেছে অনেক দেশ এবং তাহারা আমেরিকাকে এখন ট্রাম্প কার্ড দেখাইতেছে। ইহার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত দূরপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা হইতে শুরু করিয়া সাব-সাহারান আফ্রিকা, পূর্ব ইউরোপ বা লাতিন আমেরিকা কোথাও শান্তির দেখা পাওয়ার আশা করাটা বাতুলতা মাত্র।
সূত্র: ইত্তেফাক