গত ১৪ ডিসেম্বর ছিল শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। আমাদের বাঙালি জাতির জীবনের এক বেদনাঘন দিন। কারণ, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার ঘৃণ্য চক্রান্ত করে। তারা তাদের এ দেশীয় দোসরদের নিয়ে শিক্ষক, বিজ্ঞানী, চিন্তক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, ক্রীড়াবিদ, সরকারি কর্মকর্তাসহ বহু মানুষকে হত্যা করে। বিশেষ করে ১৪ ডিসেম্বর তারা ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের পর রাজধানীর রায়েরবাজার ইটখোলা ও মিরপুরের বধ্যভূমিসহ ঢাকা এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধিজীবীদের চোখ-হাত বাঁধা ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ পাওয়া যায়।
দিনটিকে গভীর বেদনার সঙ্গে স্মরণ করছিলাম আমরা। সাধারণত আমরা দেখি জাতির গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোতে বিদেশি রাষ্ট্রদূত ও মিশন প্রতিনিধিরাও অংশ নেন। ঢাকায় নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূত পিটার হাসও বেরিয়েছিলেন সেদিন। তবে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে নয়, গিয়েছিলেন রাজধানীর শাহীনবাগে। প্রায় এক দশক ধরে নিখোঁজ বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলামের বাসায় গিয়েছিলেন।
এটুকু ঠিক খবর না। ঘটেছে অন্যকিছু। এই একটি ঘটনায় বাংলাদেশকে নিয়ে আমেরিকা-রাশিয়া জড়িয়ে পড়েছে বিবৃতি ও পাল্টা বিবৃতিতে। সাজেদুলের বাসা থেকে বেরিয়ে আসার সময় বাসার বাইরে একদল লোক রাষ্ট্রদূতকে ঘিরে ধরার চেষ্টা করেন। ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান বিনা বিচারে বিভিন্ন বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাসহ যাদের ফাঁসি দিয়েছিল তাদের সন্তান-পরিজনদের সংগঠন মায়ের কান্নার কিছু সদস্য মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে স্মারকলিপি দেওয়ার জন্য সমবেত হয়েছিলেন। তিনি নিরাপত্তা কর্মীদের সহায়তায় সেখান থেকে বেরিয়ে যান। সেদিন দুপুরে শাহীনবাগের ঘটনা নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে বৈঠক করেন পিটার হাস। তিনি তাঁর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানান। পিটার হাসের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উদ্বেগ জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
গত ২০ ডিসেম্বর ঢাকাস্থ রুশ দূতাবাস এক বিবৃতিতে বলে, গণতন্ত্র সুরক্ষা বা অন্য কোনও অজুহাতে বাংলাদেশসহ তৃতীয় কোনও দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার বিষয়ে রাশিয়া বদ্ধপরিকর। একদিন পর অর্থাৎ বুধবার ওই বিবৃতি নিয়ে পাল্টা একটি টুইট করে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস। বিষয়টি এখানেই থেমে থাকেনি। রাশিয়া দূতাবাস টুইটারে আবার একটি ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করেছে। অবশেষে দুই পরাশক্তির পাল্টাপাল্টির রেশ বাংলাদেশের সীমানার বাইরে মস্কো পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বিষয় তুলে মস্কোয় বসে যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা মস্কোর স্থানীয় সময় অনুযায়ী, গত বৃহস্পতিবার নিয়মিত ব্রিফিং করেন। ব্রিফিংয়ে তিনি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের চেষ্টা শিরোনামে বিবৃতি দেন।
বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে রাশিয়ার বিবৃতিতে বিব্রত বাংলাদেশ, এমনটাই আভাস দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতি, মানবাধিকার ও নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের পরামর্শেও বিরক্ত সরকার। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গত সোমবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, আমরা চাই না রাশিয়া, আমেরিকা কেউ আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাক, এটা তাদের বিষয় নয়।
প্রশ্ন উঠতে পারে বিষয়টি এ পর্যন্ত গেলো কেন বা কীভাবে গেলো? পিটার হাস যখন শাহীনবাগে নিখোঁজ বিএনপি নেতার বাসায় গেলেন, তখন মায়ের কান্না সংগঠনের সদস্যরা গেলেন সেখানে। যোগাযোগের জায়গা থেকে একটা প্রশ্ন ওঠে, দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে বিএনপি যেভাবে মায়ের ডাক-কে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে পরিচিত করেছে, তার পাল্টা কি মায়ের কান্না সম্পর্কে জানানো গেছে? এই যোগাযোগটা খুব জরুরি ছিল সেখানে এভাবে উপস্থিত হওয়ার আগে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ নিয়ে আলোচনা আছে। অনেক দিনের আলোচনা। এবং সেটা নিয়ে উদ্বেগ ও অস্থিরতাও চিরন্তন। ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কারণেই হয়তো বাংলাদেশ বিশ্বমোড়লদের কাছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে টানাপোড়েন থাকাটাও স্বাভাবিক। তবে বাংলাদেশ নিশ্চয়ই চাইবে না কোনও কারণেই কোনও দেশের সঙ্গে তার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি ঘটুক।
বিষয়টা দুদিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করে কূটনৈতিক পথে হাঁটাই প্রত্যাশিত রাষ্ট্রদূতদের কাছে। তেমনি আমাদের দিক থেকেও বিষয়টিকে কেমন করে নাড়াচাড়া করা হবে তার একটা বাস্তবিক ভাবনা প্রয়োজন। মনে রাখতে হয়, কূটনীতিতে বিরোধের চেয়ে যোগাযোগ বড় ভূমিকা রাখে।
পিটার হাস একজন ব্যক্তি। কিন্তু তিনি বাংলাদেশে তার দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। কূটনীতিতে ব্যক্তির ভূমিকা থাকে নিশ্চয়ই। পিটার হাস ব্যক্তি হিসেবে নগণ্য নন। এবং সে কারণেই শেষ বিচারে ব্যক্তি গৌণ, বাস্তব মুখ্য। আন্তর্জাতিক রাজনীতি, কূটনীতি ও আর্থ-বাণিজ্যিক কাঠামোর নিরিখেই সব সম্পর্ককে যাচাই করতে হয়। যেকোনও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিবাদকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার অর্থ, বাংলাদেশকে অনেক প্রশ্নের জবাব দেওয়া। স্বভাবতই আমরা সেটায় অনাগ্রহী হবো। এবং সেই বাস্তবিক বোধ থেকেই সবকিছু দেখা উচিত।
তবে বাংলাদেশের বিরোধী রাজনীতিক ও নাগরিক সমাজের কেউ কেউ সবকিছুকে বিদেশিদের দ্বারা সমাধানের পথে যে যেতে চান তাদেরও বোঝা দরকার অনেক কিছু। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে বাইরে নিয়ে যাওয়া কেবল অপ্রয়োজনীয় নয়, বিপজ্জনকও। দেশের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ তাতে লঙ্ঘিত হয়। বাংলাদেশের কূটনৈতিক পরিসরে মার্কিন-চীন-ভারত ত্রয়ী সবসময়ই ছিল। বোঝা যাচ্ছে চতুষ্টয়ী হিসেবে রাশিয়া ক্রমশ উদীয়মান। এই বিবর্তনকে কীভাবে পরিচালিত করা হবে সেটিই আমাদের পরীক্ষা।
লেখক: সাংবাদিক