ত্রিশের কবিদের স্টাইলের দাপট ভেঙে সম্পূর্ণ নিজস্ব ও বঙ্গজ উপাদান নিয়ে কবিতা নির্মাণে সক্ষমতা দেখিয়েছেন কবি জসীম উদদীন। কবিতার সমস্ত উপাদান—চিত্রকল্প, অলংকার, ছন্দ, রস প্রভৃতি—বাঙালির, দেশজ, গ্রামীণ সংস্কৃতির। তার রচিত চারটি আখ্যানকাব্যেও একই রীতি অবলম্বন করেছেন। মিথও নিয়েছেন দেশজ উৎস থেকে।
জসীম উদদীনের আখ্যানমূলক কাব্য চারটি হচ্ছে : ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ (১৯২৯), ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ (১৯৩৩), ‘সকিনা’ (১৯৫৯) ও ‘মা যে জননী কান্দে’ (১৯৬৩)। আখ্যানমূলক কাব্যগুলোর শব্দাবলি বা উপাদানগুলো আশেপাশের; সবুজবাংলার ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কিন্তু মাইকেল, নজরুল বা রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ কবি আখ্যান বা কবিতায় রামায়ণ-মহাভারত, লোকপুরাণ বা ধর্মীয় ঐতিহ্যের কাছে হাত পেতেছেন। এক্ষেত্রে জসীম উদদীন ব্যতিক্রম ও অনন্য। তার আখ্যানকাব্য জনপ্রিয়তা ও নির্মাণশৈলীতে অনন্য। জসীম উদদীনের অন্ত্যমিলের কবিতাগুলো কানে সমধুর ঝংকার তোলে। ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ সর্বাধিক জনপ্রিয় কাব্য। ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ও জনপ্রিয় কাব্য। এ দুটি আখ্যানকাব্যে হিন্দু-মুসলিমদের সহাবস্থান, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও তৎকালীন পরিবেশ ও ঘটনা পরিক্রমায় লিখিত। রাখালী(১৯২৭) কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ। এছাড়া ‘বালুচর’ (১৯৩০), ‘ধানখেত’(১৯৩৩), ‘হাসু’(১৯৩৮), ‘মাটির কান্না’(১৯৫১), ‘এক পয়সার বাঁশি’(১৯৫৬), ‘হলুদ বরণী’ (১৯৬৬), ‘জলে লেখন’(১৯৬৯), ‘পদ্মা নদীর দেশে’(১৯৬৯), ‘দুমুখো চাঁদ পাহাড়ি’(১৯৮৭) উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। জসীম উদ্দীনের ‘হাসু’ চমৎকার একটি শিশুতোষ কাব্য। শিশুমনকে নাড়া দেওয়ার মতো অনেক ছড়া আছে এ গ্রন্থে। ‘আমার বাড়ী’ ছড়াংশ—
আমার বাড়ী যাইও ভ্রমর বসতে দেব পিঁড়ে
জলপান যে করতে দেব শালিধানের চিড়ে।
ছোটবেলা থেকেই সৌন্দর্যের প্রতি খুব প্রবল আগ্রহ ছিল। নদী, প্রকৃতি ও নারীর সৌন্দর্য উপভোগ করতেন তিনি। ‘মুখখানা যেন সিন্দুরের মতো ডুগু ডুগু করে’ বলে উজ্জ্বল নারীর প্রতি টানের কথা বোঝা যায়। সে সময়ে হিন্দু ও মুসলমানের বাস ছিল বৃহত্তর ফরিদপুর, বলা যায় বাংলার অনেকস্থানে। মাঝেমধ্যে সম্প্রীতির ফাটল দেখা যেত। এসব নিয়ে কবিতায় তুলে ধরেছেন তিনি। তবে হিন্দুদের বাড়িতে যাতায়াত ছিল তার, ছোটবেলা থেকেই। হিন্দু রমণীদের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতেন তিনি। কবির নিষ্পাপ চোখের বর্ণনা পাই আমরা বিভিন্ন কবিতায়, আখ্যানকাব্যে। ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ আখ্যানকাব্যে সাজুর সৌন্দর্য যেমন দেখি ‘লাল মোরগের পাখা’, তেমনই ‘তুলসীতলার প্রদীপ, তুলসীফুলের মঞ্জুরী কি দেব দেউলের ধূপ’, ‘সাঁঝ সকালের রঙিন মেঘেরা, ইত্যাদি সৌন্দর্যের বৈচিত্র্যময়তা লক্ষ করা যায়। চিত্রকল্প নির্মাণ করতে যেয়ে বিভিন্ন অলংকার (উপমা ইত্যাদি) দেশের কাছেই হাত পেতেছেন তিনি। কিছু কিছু অংশ (তার কবিতা থেকে) তুলে ধরলেই তা পরিষ্কার হবে। নারীর অনুভব খুব গভীরতর। নারী ও প্রকৃতি মিলে দারুণ প্রকাশে ব্যঞ্জনা পেয়েছে জসীম উদদীনের কবিতায়। বাঙালি সংস্কৃতি নিয়েই তার কবিতায় ওজস্বিতা প্রকাশ পেয়েছে।
‘ঘুম হতে আজ জেগেই দেখি/ শিশির ভেজা ঘাসে/ সারারাতের স্বপন আমার/ মিঠেল রোদে হাসে।’ জসীম উদদীন বাংলার গ্রামের উপাদান নিয়ে প্রকৃতিকে আধুনিকতা দিয়েছেন। তার কবিতা পাঠকের হৃদয়ে ঢুকে পড়েছে। গ্রামীণ জনপদের সমস্ত অস্তিত্বে কবি জসীম উদদীন মিশে গেছেন; বৃহত্তর বাংলার কৃষকসমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে তার নিবিড় বোঝাপড়াটা ভালোই জমেছিল; তার কবিতাতেই প্রমাণ। ‘‘রাখাল ছেলে’’ কবিতা থেকে : ‘ঝাউয়ের ঝাড়ে বাজায় বাঁশী পউষ-পাগল বুড়ী,/আমরা সেথা চষতে লাঙল মুর্শীদা-গান জুড়ি।’ কাশফুলের গুচ্ছ, বালুচর, সরিষা, শিশির, মিঠেল রোদ, রঙিন কাঁথা, বুনো ফুল, ফড়িং, টিয়া, ঘুঘু, ইত্যাদি—গ্রামের প্রতিবেশ, ছবি–অনায়াসেই এনেছেন কবিতার ছত্রে। ‘ফোঁটা সরিষার পাপড়ির ভরে, চরো মাঠখানি কাঁপে/ থরে থরে সাঁঝের শিশির দুটি পাও ধরে কাঁদিয়া ঝরে—/ বাঁশরী আমার হারায়ে গিয়াছে বালুর চরে (বালুচর)’। গ্রামের উপাদান নিয়ে জসীম উদ্দীন লিখেছেন। অন্ত্যমিলেও দারুণ হয়েছে। অন্ত্যমিল দিতে গিয়ে কবিতার বার্তা বা বক্তব্য অস্পষ্ট হয়নি। এখানেই কবি হিসাবে তিনি স্বকীয় ও সার্থক। ‘মাথায় তাহার কুলোর উপর বদনা-ভরা জল,/ তেল-হলুদে কানায় কানায় করছে ছলাৎ ছল(পরিচ্ছেদ ৪, নকশী কাঁথার মাঠ)’। ‘‘পল্লী বর্ষা’’ কবিতার অংশ বিশেষ : ‘আজিকে বাহিরে শুধু ক্রন্দন ছল ছল জলধারে/ রেণু-বনে বায়ু নাড়ে এলোকেশ, মন যেন চায় কারে।’ বর্ষা বিরহের ঋতু। বর্ষার সুর বেদনা ও একাকিত্বকে জাগিয়ে তোলে। পল্লীকবির এ চরণ যেন আমাদেরই মনের কথা। জসীম উদদীনের কবিতায় লোকবাংলার স্নিগ্ধ নিসর্গ যেমন উঠে এসেছে তেমনই উঠে এসেছে গ্রামবাংলার নানা অসঙ্গতি, শোষণের কথা, অনিয়মের কথা। জেলের বউয়ের মন-খারাপ উঠে আসে এমন, ‘ইচ্ছে করে কলসীটিরে বাঁধি মাথার কেশে,/ ভাসিয়ে দেয় জেলে তাহার রয় যে বে-গান দেশে(জেলে গাঙে মাছ ধরিতে যায়)’। আসলে তিনি বাংলার মানুষের জীবন-জীবিকার ভাষ্যকর। তাইতো তিনি সহজেই বলতে পারেন, ‘কাঁদে এই মাটি। আমি শুধু শুনি মাটিতে এ বুক পাতি,/ মাটির বুকের স্পন্দন শুনি, জাগিয়া দীঘল রাতি।’ গ্রাম বাংলার মানুষের আতিথেয়তা বিশ্ববিখ্যাত। ‘নিমন্ত্রণ’ কবিতায় জসীম উদ্দীনের স্বর এভাবেই বাংলার প্রতিনিধিত্ব করে, ‘তুমি যাবে ভাই-যাবে মোর সাথে, আমাদের/ছোট গাঁয়,/ গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়;/ মায়া মমতায় জড়াজড়ি করি/ মোর গৃহখানি রহিয়াছে ভরি,/ মায়ের বুকেতে, বোনের আদরে, ভাইয়ের/ স্নেহের ছায়,/ তুমি যাবে ভাই-যাবে মোর সাথে, আমাদের/ ছোট গায়।’ গ্রামবাংলার বর্ষার দৃশ্য-মেঘ নিয়ে কবির বর্ণনা : ‘আজিকের রোদ ঘুমায়ে পড়েছে ঘোলাটে মেঘের আড়ে,/ কেয়া বন পথে স্বপন বুনিছে ছল ছল জল ধরে।/ কাহার ঝিয়ারী কদম্ব-শাখে নিঝুম নিরালায়,/ ছোট ছোট রেণু খুলিয়া দেখিছে অস্ফুট কলিকায় (পল্লী বর্ষা)’। রূপক, উপমা, প্রতীক, রূপকল্পের বিচিত্র, নৈপুণ্যপূর্ণ ব্যবহার আধুনিক কবিতার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। আগের যুগেও এর ব্যবহার ছিল। চিরচেনা পরিবেশ নিয়ে জসীম উদদীনের কবিতার চিত্রায়ণ খুব স্বাভাবিক বিষয় বলেই মনে হয়। আশেপাশের লোকজ উপাদানের এমন কিছু কবিতাংশ তুলে ধরছি:
(১)
মাঠের যতনা ফুল লয়ে দুলী পরিল সারাটি গায়,
খোঁপায় জড়ালো কলমীর লতা, গাঁদা ফুল হাতে পায়
(সোজন বাদিয়ার ঘাট)
(২)
রাখাল ছেলে! রাখাল ছেলে! সারাটা দিন খেলা,
এ যে বড় বাড়াবাড়ি, কাজ আছে যে মেলা।
‘কাজের কথা জানিনে ভাই, লাঙ্গল দিয়ে খেলি,
নিড়িয়ে দেই ধানের খেতের সবুজ রঙের চেলি’।
(রাখাল ছেল, রাখালী)
বলে রাখি, এমন সাধারণ উপাদানে অসাধারণ বুননের কবিতা অনেক। উল্লেখিত কবিতাংশ তার কবিতার প্রতিনিধি হিসাবেই ধরে নেওয়া শ্রেয় হবে। আধুনিক কবিতায় অলংকারের প্রয়োগ লক্ষণীয়। কবি জসীম উদদীন কবিতায় উপমা-উৎপ্রেক্ষা, সমাসোক্তি ও অন্যান্য অলংকারের জুতসই ব্যবহার ও প্রয়োগ দেখা যায়। তার অলংকারের বেশিরভাগ উপাদানই লোকজ। জুতসই উপমা ও অনুপ্রাসের ব্যবহার কবিতার শিল্পগুণকে উন্নীত করেছে। প্রতিনিধি হিসাবে কিছু উল্লেখ করছি। প্রথমেই ‘নকশীকাঁথার মাঠ’ থেকে কিছু অলংকারিক(উপমা ও অনুপ্রাস) প্রয়োগ দেখে নিই: ‘কাঁচা ধানের পাতার মত কচি মুখের মায়া’, ‘লাল মোরগের পাখার মত ওড়ে তাহার শাড়ী’, ‘কচি কচি হাত-পা সাজুর সোনার সোনার খেলা,(যমক)/তুলসী তলার প্রদীপ যেন জ্বলছে সাঝের বেলা’, ‘তুলসী ফুলের মঞ্জুরী কি দেব দেউলেত ধূপ’, ‘কালো মেঘা নামো নামো, ফুল তোলা মেঘ নামো’, ‘বাজে বাঁশী বাজে, রাতের আঁধারে, সুদূর নদীর চরে,/উদাসী বাতাস ডানা ভেঙে পড়ে বালুর কাফন পরে(সমাসোক্তিসহ)’। অন্যান্য কাব্য থেকে কিছু উদাহরণ টেনে দিতে পারি এভাবে :
(১)
চলে বুনো পথে জোনাকী মেয়েরা কুয়াশা কাফন পরি।
দুর ছাই,কিবা শঙ্কায় মার পরাণ উঠিছে ভরি
(উপমা ও অনুপ্রাস প্রয়োগ, পল্লী জননী, রাখালী)
(২)
হেমন্ত চাঁদ অর্ধেক হেলি জ্যোৎস্নায় জাল পাতি,
টেনে টেনে তবে হয়রান হয়ে, ডুবে যায় সারারাতি
(সমাসোক্তির প্রয়োগ, নকসী কাঁথার মাঠ)
চরিত্র নির্মাণে (বিশেষত নায়ক-নায়িকা) কবি জসীম উদদীন মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। উপমার প্রয়োগে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। আর অন্ত্যানুপ্রাস তো কবির স্বভাবজাত।
(১)
সোজন যেনবা তটিনীর কূল, দুলালী নদীর পানি
জোয়ারে ফুলিয়া ঢেউ আছড়িয়া কূল করে টানাটানি
নামেও সোজন, কামেও তেমনি,শান্ত স্বভাব তার
কূল ভেঙে নদী যতই বহুক, সে তারি গলার হার
(সোজন বাদিয়ার ঘাট)
(২) ‘সকিনা’ আখ্যানকাব্যে নায়িকা সকিনাকে নিয়ে নায়ক আদিলের স্বপ্ন; জসীম উদদীনের কবিতায়,
সকিনারে লয়ে আদিল এবার পাতিল সুখের ঘর,
বাবুই পাখীরা নীড় বাঁধে যথা তালের গাছের পর।
স্রোঁতের শেহলা ভাসিতে ভাসিতে একবার পাইল কূল,
আদিল বলিল, ‘‘গাঙের পানিতে কুড়ায়ে পেয়েছি ফুল’’।
এই ফুল আমি মালায় মালায় গাঁথিয়া গলায় পরিয়া নেব,
এই ফুল আমি আতর করিয়া বাতাসে ছড়ায়ে দেব।
এই ফুল আমি লিখন লিখিব, ভালোবাসা দুটি কথা,
এই ফুলে আমি হাসিখুশি করে জড়াব জীবনলতা।
বাংলাসাহিত্যের তিন গ্রান্ডকবি—কাজী নজরুল (১৮৯৯), জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯) ও জসীম উদদীন (১৯০৩)—জন্ম প্রায় একই সময়ে। কিন্তু তাদের স্টাইলে ভিন্নতা ছিল। ফলে তিনজনই টিকে আছেন স্বমহিমায়। নজরুলর বিদ্রোহী সুর আর জীবনানন্দের প্রকৃতির অবগাহনের পাশাপাশি জসীম উদদীন গ্রামের ছবি এঁকেছেন কবিতায়। বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের কথা তার কবিতায়। তিনি গ্রামীণ বাঙালি সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান নিয়েই নির্মাণ করেছেন তার কবিতা।
লেখক: আবু আফজাল সালেহ