মুক্তভাষ ডেস্ক
খ্রিষ্টীয় ২০২২ সাল বিদায় নিল। বছরের শেষ দিন মধ্যরাত থেকে ঢাকা শহরের পাড়ায় পাড়ায়, বাড়ির ছাদগুলোতে ফুটল অসংখ্য পটকা ও আতশবাজি। উড়ল অগণিত ফানুস। পুলিশ ও প্রশাসনের নানা বিধিনিষেধের পরও নতুন বছর বরণের এই বিপুল কোলাহল দমিয়ে রাখা যায়নি অন্যান্য বছরের মতোই।
যথারীতি এর প্রতিক্রিয়া নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে উত্তপ্ত বিতর্কে লিপ্ত। এক দলের দাবি, এসব শব্দ তৈরি করা নেহাতই অমানবিক কাজ। এই সব শব্দ শিশুদের জন্য, প্রবীণদের জন্য ভয়াল এক পরিবেশ তৈরি করে। আমরা গত বছর সংবাদমাধ্যমে দেখেছিলাম, এক দুর্বল হৃদয়ের শিশুর হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়াই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
তবে মানুষের এই ক্ষতির চেয়ে ঢের বেশি ক্ষতি হয় পাখিদের। এই শব্দ আর ফানুসের আগুনে, পরের দিন অসংখ্য ভীত পাখির মৃতদেহ মেলে নতুন বছরের প্রথম দিনে ঢাকার রাজপথে। আর এবার তো ফানুসের কবলে পড়ে সদ্য চালু হওয়া মেট্রোরেলকেই বন্ধ রাখতে হয়েছিল দুই ঘণ্টার জন্য।
বিপরীত দলের দাবি হচ্ছে, তবে কি মানুষ উৎসব করবে না? নববর্ষের রাতে তো দুনিয়ার হেন কোনো জায়গা নেই যে উৎসব হয় না? কোটি দুয়েক মানুষের নগরী ঢাকার চেয়ে অনেক বেশি আলো আর শব্দের উৎসব চলে দুনিয়ার অন্যান্য মহানগরে।
তারা করতে পারলে আমাদের মানুষদের, বিশেষত তরুণদের কী দোষ? এমনিতেই তো এই দেশের পার্বণপ্রিয় মানুষ এখন উৎসব করতে পারে না নানা রকম সরকারি-বেসরকারি বাধায়।
এই দলের আরও একটি দাবি হচ্ছে, মানলাম একটু সমস্যা হয়, কিন্তু সে তো এক দিনের জন্যই। একটু রয়েসয়ে নিলেই হয়! আমরা কি রয়েসয়ে নিচ্ছি না প্রতিনিয়ত? কারও কোটার চাকরি হচ্ছে না, দাও রাজপথ বন্ধ করে। শিক্ষকদের চাকরি সরকারীকরণ হচ্ছে না, দাও রাস্তায় জ্যাম বাধিয়ে। বেপরোয়া গতির ড্রাইভারের বলি হলো রাস্তায় কেউ, পিটিয়ে ভেঙে দাও সব গাড়ি। নববর্ষ তো তাও এক দিন, পাড়ার কেউকেটা হলেই তাঁদের জন্মদিন, গায়েহলুদের অনুষ্ঠানগুলোও হয় ইদানীং সারা রাত বিকট সব গানে। বুড়ো, শিশুদের কেই-বা থোড়াই কেয়ার করে! আর পাখি! নৈব নৈবচ!
মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্রথম দলের যৌক্তিক ক্ষোভের প্রতিউত্তর দিতে গিয়ে এই শেষের যুক্তি দিয়ে আসলে তাঁদের আলাপটাকেই মেনে নেয় দ্বিতীয় দল। যে উৎসবে সহনাগরিককে আতঙ্কিত করে তোলা হয়, যেখানে অপরকে জিম্মি করে উৎকট আনন্দ হয়ে ওঠে লক্ষ্য, তা কোনোভাবেই সুস্থতার লক্ষণ না।
কিন্তু এই অসুস্থতার বীজ আসলে কই? এর বীজ হচ্ছে দেশের মানুষের ‘নাগরিক’ না হয়ে ওঠায়। ঔপনিবেশিকতার সময় কয়েক যুগ পার হলেও সেই একই ধারায় শাসক আর শাসিতের সম্পর্ক বজায় রাখায়। আহমেদ ছফার মতো করে বললে, বিদেশি বুটের বদলে স্বদেশি ভাইয়ের বুটের থাবায় পিষ্ট হয়ে আহা-উঁহুর বদলে আবেগের জাতীয় সংগীত গাওয়া।
এই অঞ্চলের শাসকেরা নাগরিকের সম্মান নামক বিষয়টা কখনোই প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ দেননি। ভোট ব্যাপারটা কদাচ হলেও তা আসলে বেশির ভাগ সময়েই প্রহসন হিসেবেই রয়ে গেছে। আর ভোট যদি হয়েও থাকে, জনগণের সঙ্গে জবাবদিহির ব্যাপারটা তো নাই-ই। ঔপনিবেশিকেরা যেমন সব সুযোগ-সুবিধা পেত আর বাকিরা ছিল দ্বিতীয় কিংবা এরও নিচু শ্রেণির, দেশের প্রায় সবখানে এ অবস্থা দেখা যায়। বেঁচে থাকার তাড়নায় নাগরিকের প্রধান কৌশল হয়ে ওঠে মানিয়ে নেওয়া। তা নববর্ষের বোমার বিকট আওয়াজ হোক বা অসীম ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠা পাড়ার গুন্ডার মাস্তানি কিংবা সরকারি পর্যায়ের বিপুল দুর্নীতি। মূলত কোটি কোটি মানুষের শ্রমের যে ফসল, তা লুট করে নেয় এই অভিজাতেরা। জনতা হয় খেটে মরে, নতুবা এই চক্রে যুক্ত হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে। আর অতি অবশ্যিই, আরেক দল দেশ ছেড়ে পালায়।
এসব তো জানা কথা। মোটাদাগের কথা। কিন্তু উপনিবেশ যুগের আলাপ টেনে আনা কেন? কারণ, এগুলো যারা সমাধান করবে, যারা স্বাধীন দেশের নাগরিককে সম্মানের জন্য উদ্বুদ্ধ করবে, সেই আপাত ‘সৎ রাজনীতির চর্চাও’ কলোনিয়াল হ্যাংওভারে আসক্ত।
রাস্তা আটকে, জ্যাম বাধিয়ে, মাইকের উচ্চশব্দে নাগরিকের জীবন অতিষ্ঠ করার কথা তো বলাই হলো। এগুলোর চেয়ে আপাত বহু নিরীহ একটা ব্যাপার হচ্ছে, দেয়ালে দেয়ালে চিকা কিংবা পোস্টার মারা। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে এই কাজ করতাম গর্ব নিয়ে। ব্যাপারটা ছিল ‘মহান’ এক অর্জনের অংশ। এতে বাড়ির মালিকের ক্ষতি হলো কি না, সৌন্দর্য নষ্ট হলো কি না, সে নিয়ে ভাবার মানে নেই।
‘বিপ্লব স্পন্দিত বুকে আমিই চে’—এহেন দীপ্তচেতনায় বরং এসবে কেউ বিরক্ত হলে পেটিবুর্জোয়া, এমনকি শ্রেনীশত্রুও ধরে নিতাম!
এই যে আমার ভাবনাই মহান, সহনাগরিক আমার বিপ্লব সইবে, এই ভাবনার বীজ যে মহীরুহ তৈরী করে ফেলতে পারে, তরুণ মনে এই চিন্তা আসতো না। চে এর মতো উদ্দাম কিন্তু রাতভর ‘লাড়কি আখ মারে’ গান গেয়ে আনন্দ করা তরুণেরাও একই রকম অধিকারের চর্চা করতে পারে একসময় তা মাথায় আসেনি।
দীপেশ চক্রবর্তী তাঁর ‘রাজনীতির রাস্তা: পথ অবরোধ ও গণতন্ত্র’ নামক লেখায় কলকাতায় এই গণচর্চা নিয়ে বিশদে লিখেছেন। টেনে এনেছেন বেশ কিছু উদাহরণ।
সেখান থেকে জানা যায়, ১৮৫০ দশকের গোড়ায় কলকাতার দেয়ালে প্রস্রাব করা নিষিদ্ধ করে ‘কমিট টু নুইসেন্স’ আইন চালু হলে তাঁর বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন কবি ঈশ্বর গুপ্ত। ‘মূত্রসূত্র’ ধরিয়া পুলিশের ‘বাঙ্গালীর ওপর অত্যাচার’-এর প্রতিবাদ করেছিলেন।
পরাধীন দেশের জনতাকে এই উসকে দেওয়া সহজ ছিল। ক্রোধের বশবর্তী কবি এ-ও ভাবেননি যে, যত যুক্তিই দেওয়া হোক, নুইসেন্স ব্যাপারটাকে মেনে নেওয়ার সুযোগ নেই।
কিন্তু হায়! দেড় শ বছর পর এগুলো আরও যেন পোক্ত হলো। পপুলিজম বা লোকরঞ্জনবাদের রাজনীতি ঔপনিবেশিক যুগের মতো মানুষকে সর্বদা উত্তেজিত করে, নানা ভাগে ভাগ করে, সর্বোপরি নাগরিকের ন্যূনতম সম্মানের আলাপ ভুলিয়ে দিতে পারে, এটা খুব ভালো বুঝেছেন স্বদেশি শাসকেরা। আর এমনকি সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখারাও সেই ফাঁদে পা দিয়েছে। দুটি পোস্টার সেঁটে দেওয়ার অধিকার, রাস্তা আটকে গান আর প্রতিবাদের অধিকার জারি রাখতে গিয়ে সহনাগরিকের বিরক্তির কারণ হয়েছে।
এর মানে কি এই যে হরতাল-অবরোধের মতো স্বীকৃত ও উপযুক্ত হাতিয়ার বিসর্জন দিতে হবে? আর আমাদের শাসকদের যেহেতু জবাবদিহি শূন্যের কোঠায়, ফলে এই ঠেলাটা না দিলে তো কিছুই আদায় হবে না। বরং এসবের বদৌলতে মানুষের কিছু হলেও অধিকার রক্ষা পাচ্ছে।
কিন্তু বারবার ব্যবহারে একদিকে যেমন এগুলো হয়ে যাচ্ছে ক্লিশে আর জনতার থেকে বিচ্ছিন্ন, তেমনি সৃষ্টি করছে সামাজিক সমস্যা। ঔপনিবেশিক সময়ের ঝাঁজালো দাবি আদায়ের পথ, আর আমার দাবিতে দেশবাসী ‘একটু’ সয়ে নেবে, স্বাধীন দেশে এই রাজনীতিটা, এই মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি।
শুনতে গালগল্পের মতো লাগে। এভাবে জবাবদিহিবিহীন, বেপরোয়া শাসককে লাইনে আনার চিন্তা করা অবিমৃশ্যকারিতা মনে হয়। কিন্তু আজ হোক কাল হোক এই চর্চা শুরু করা জরুরি। মেট্রোরেলের লাইনের ফানুস সরিয়ে দুই ঘণ্টা পর ট্রেন তো তা-ও চলল, সামাজিক এসব ফানুসের পথ পরিষ্কার করে বাংলাদেশ সামনে এগোতে পারবে কি?
সৈয়দ ফায়েজ আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক