রাজস্ব খাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণ করতে আগামী ৩ অর্থবছরে বাংলাদেশকে রাজস্ব হিসাবে ২ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা আয় করতে হবে। এর মধ্যে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরেই আদায় বাড়াতে হবে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ আইএমএফের কাছ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ পাচ্ছে। এই ঋণ বাংলাদেশ পাবে ৭ কিস্তিতে ৩ বছরে। এ ক্ষেত্রে সংস্থাটির শর্তই হচ্ছে কর-জিডিপির অনুপাতে প্রতি বছরই সরকারকে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। তবে শুধু আইএমএফের চাপে এসব সংস্কার না করে বরং নিজেদের সক্ষমতা বাড়াতেই এই সংস্কার হওয়া প্রয়োজন। তাছাড়া আইএমএফ যে শর্ত দিয়েছে, তা কঠোর কিছু নয়। সুতরাং এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। রাজস্ব খাতের ক্ষেত্রে আইএমএফের সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন অসম্ভব নয়। এ জন্য সরকারের সদিচ্ছার পাশাপাশি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও বদলাতে হবে। তবে সব ছাপিয়ে কর-জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আয় বাড়ানোর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত। আইএমএফ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে কর-জিডিপির অনুপাত দশমিক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৮ দশমিক ৩ করার শর্ত দিয়েছে। এই শর্ত পূরণ করতে গেলে বর্তমানে আমাদের যে রাজস্ব আয় আছে, তার থেকে প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত আয় করতে হবে। এরপরের অর্থবছর অর্থাৎ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষে কর-জিডিপির অনুপাত হবে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ। তাতে বর্তমান রাজস্ব আয় থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে অতিরিক্ত রাজস্ব আয় করতে হবে ৭৩ হাজার কোটি টাকার ওপরে। আর আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির সর্বশেষ বছর অর্থাৎ ২০২৫-২৬ অর্থবছরে কর-জিডিপির অনুপাতের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ। এই অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বর্তমান আয়ের তুলনায় অতিরিক্ত আরো ৯৬ হাজার কোটি টাকা আয় করতে হবে। সব মিলিয়ে আগামী ৩ অর্থবছর শেষে ২ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকার বাড়তি রাজস্ব আদায় করতে হবে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে এনবিআরকে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য দেয়া হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৪০ হাজার কোটি টাকা বেশি। আগের অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৩ লাখ ২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করেছে এনবিআর। সুতরাং লক্ষ্য অর্জনে চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে প্রায় ২৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে হবে। এনবিআরের কাঠামোগত সংস্কার ও মানসিকতার বদল করা না গেলে আইএমএফের শর্ত মেনে রাজস্ব খাতের সংস্কার বাস্তবায়ন করা সরকারের জন্য কঠিন হবে। সুনির্দিষ্টভাবে আমাদের কাছে এখনো কোনো তথ্য নেই, কোন কোন খাত থেকে কর আসতে পারে। এগুলো স্বচ্ছ করতে হবে। কাঠামোগত সংস্কারের মাধ্যমে লক্ষ্যটা কীভাবে অর্জন করা যায়, তা নিয়ে আরো কাজ করতে হবে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় রাজস্ব আদায়ের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান সর্বনিম্ন দেশগুলোর একটি। এর ফলে বাংলাদেশ শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সামাজিক খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখতে পারছে না। দেশে এখন স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় জিডিপির ১ শতাংশের কম। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক মান হচ্ছে ৩-৫ শতাংশ। আর শিক্ষা খাতে ব্যয় জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ, যা ইউনেস্কোর ঠিক করা লক্ষ্যের অর্ধেক। কর-জিডিপি অনুপাত ৫ শতাংশ বাড়ানো গেলে প্রকৃত জিডিপি ৩ দশমিক ৩ শতাংশ বিন্দু পর্যন্ত বাড়বে আর এতে দারিদ্র্যের হার কমবে ২ দশমিক ২ শতাংশ বিন্দু। এ অবস্থায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজস্ব আদায় বাড়ানো সম্ভব? যেমন- বিদ্যমান কর অব্যাহতি হ্রাস, ব্যক্তি খাতে আয়কর আদায়ব্যবস্থা ও করপোরেট আয়ের অসঙ্গতি দূর এবং মূল্য সংযোজন করের (ভ্যাট) সংস্কার। কর অব্যাহতি কমাতে পারলে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ, ব্যক্তি খাতের আয়কর আদায় ব্যবস্থার অসঙ্গতি দূর করতে পারলে আরো ২ দশমিক ১ শতাংশ এবং ভ্যাটব্যবস্থার সংস্কার করলে বাড়বে দশমিক ৬ শতাংশ। বর্তমানে আয়করে ৮৫ লাখ নিবন্ধন আছে, কিন্তু রিটার্ন দেয় এর মাত্র এক-তৃতীয়াংশ। আবার বাংলাদেশে করপোরেট করহার সর্বোচ্চ হলেও মোট আদায় কম। কারণ এখানে মাত্র ২৯ হাজার কোম্পানি করপোরেট কর রিটার্ন দেয়। অথচ নিবন্ধিত কোম্পানির সংখ্যা ২ লাখ ৭৩ হাজার। সুতরাং এসব ক্ষেত্রে করের আওতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতেই ২০২৪-২৫ অর্থবছর শেষে কর-জিডিপির ১২ দশমিক ৩ শতাংশ করার কথা রয়েছে। সুতরাং যদি আইএমএফের সব শর্ত পালন করা হয়, তাহলেও জিডিপিতে করের অবদান হবে মাত্র ৯ শতাংশ।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পক্ষে কি অতিরিক্ত এই রাজস্ব আয় সম্ভব? এটা অসম্ভব মনে হয় না। আর সে ক্ষেত্রে আইএমএফ বাস্তবতার আলোকেই বলছে। তবে এটা অর্জন করতে হলে দরকার আন্তরিকতার। সেই সঙ্গে দক্ষতা ও জনবল নিয়োগের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। ছিদ্রগুলো বন্ধ করতে হবে। এনবিআরের ভাবমূর্তি বাড়াতে হবে। এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী, দেশের মাত্র ১ দশমিক ১ শতাংশ আয়কর দেন। আর ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকের এক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগই বলেছে, বিশ্বের উদীয়মান দেশ ও এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোয় জিডিপির তুলনায় কর বা রাজস্ব সংগ্রহের হার বাংলাদেশের থেকে বেশ বেশি; অর্থাৎ ২৬ দশমিক ৭ শতাংশ। এমনকি সাব-সাহারা আফ্রিকার দেশগুলোর কর-জিডিপি হারও বাংলাদেশের চেয়ে বেশি; অর্থাৎ ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ। আবার আইএমএফের এক প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে অর্থ বিভাগ বলেছে, কর-জিডিপির হারে নিকটতম প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায়ও বাংলাদেশের অবস্থা খারাপ। যেমন নেপালের কর-জিডিপি অনুপাত ২৩ দশমিক ৩, ভারতের ২০ দশমিক ৩, পাকিস্তানের ১৫ দশমিক ২ এবং শ্রীলঙ্কার ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ। সরকারি হিসাবে দেশে বর্তমানে কর-জিডিপি অনুপাত ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। বাংলাদেশের রাজস্ব আয় অত্যন্ত কম। দেশের রাজস্ব আয় এখন মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) মাত্র ৯ দশমিক ৪ শতাংশ। আর প্রতি বছর সরকারের রাজস্ব আয়ের ২১ দশমিক ১ শতাংশ ব্যয় হয় ঋণের সুদ পরিশোধে। বিপুল অঙ্কের এ ঋণদায় মেটাতে সরকারকে ধারাবাহিকভাবে বাজেট ঘাটতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আবার বাজেটের ঘাটতি মেটাতে সরকারকে আবারো ঋণ নিতে হয়। এভাবে ঋণ পরিশোধের চাপ সামলাতে হয় বলে জলবায়ু অর্থায়নে ধারাবাহিকভাবে পিছিয়ে থাকছে। বাজেট বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে জলবায়ু অর্থায়নে বাজেটে বরাদ্দ ছিল জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ। আর এর আগের দুই অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরে দেশের সরকারি ঋণের পরিমাণ ১৪ হাজার ৭৮০ কোটি ডলার। এর ৫৮ শতাংশই দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেয়া ঋণ। আর বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৬ হাজার ২০০ কোটি ডলার। সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের এক যৌথ প্রতিবেদনে ঋণের স্থায়িত্ব বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ এখনো নিম্ন ঋণ ঝুঁকিতে আছে। কিন্তু বিশ্ববাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও বৈশ্বিক মন্দার প্রেক্ষাপটে আরো অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতি সংকটের মুখে পড়েছে। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ১ শতাংশে নেমে আসার পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। বছরজুড়েই ছিল উচ্চ মূল্যস্ফীতি, যা এখন ৮ শতাংশের বেশি। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত নিয়ে আছে নানা উদ্বেগ। চলতি হিসাবের ভারসাম্য ঠিক রাখতেও সরকারকে হিমশিম খেতে হয়েছে। রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে ওঠানামা রয়েছে। আবার ডলারের বিপরীতে টাকার ব্যাপক অবমূল্যায়নের ফলে ঋণ পরিশোধে অতিরিক্ত অর্থ গুনতে হবে। রাজস্ব খাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণ করতে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে চলতি বছরের লক্ষ্যমাত্রার অতিরিক্ত ৬৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয় করতে হবে। এর পরের বছরগুলোতে এই আয় আরো বাড়াতে হবে। রাজস্ব আয় বাড়াতে আইএমএফের পক্ষ থেকে এখনো সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা না পাওয়া গেলেও বাজেটের আগে ধাপে ধাপে তা আসবে। তবে আইএমএফের চাপে নয়; বরং নিজেদের সক্ষমতা বাড়াতেই এই সংস্কার করা প্রয়োজন। রাজস্ব খাতের ক্ষেত্রে আইএমএফের সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করা চ্যালেঞ্জের হবে। তবে এটা অসম্ভব নয়। এ জন্য সরকারের সদিচ্ছার পাশাপাশি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও বদলাতে হবে। তবে সব ছাপিয়ে যে আলোচনা এখন প্রাধান্য পাবে, তা হচ্ছে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআরকে বর্তমান লক্ষ্যমাত্রার অতিরিক্ত ৬৫০ বিলিয়ন বা ৬৫ হাজার কোটি টাকা আয় করতে হবে। এর পরের অর্থবছর, অর্থাৎ ২০২৫ সালের জুনে সমাপ্ত বছরে বর্তমান বছরের লক্ষ্যমাত্রা থেকে অতিরিক্ত রাজস্ব আয় করতে হবে ১ হাজার ৩৮৩ বিলিয়ন টাকা বা ১ লাখ ৩৮ হাজার ৩০০ কোটি কোটি টাকা। আইএমএমের ঋণ কর্মসূচির সর্বশেষ বছর, অর্থাৎ ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এনবিআরকে বর্তমান লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অতিরিক্ত আরো ২ হাজার ৩৪০ বিলিয়ন টাকা বা ২ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে হবে। উল্লেখ্য, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে এনবিআরকে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করার লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে। এনবিআরের কাঠামোগত সংস্কার ও মানসিকতার বদল করা না গেলে আইএমএফের শর্ত মেনে রাজস্ব খাতের সংস্কার বাস্তবায়ন করা সরকারের জন্য কঠিন হবে।
রেজাউল করিম খোকন : সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক।
ananno86bolly@gmail.com